প্রতীকী ছবি।
জীবদ্দশায় এই দিনটা দেখবেন কখনও ভাবেনইনি মদনমোহন দাঁড়ি। দেড়শো বছরের পুরনো একদা ভারত বিখ্যাত বাউড়িয়া কটন মিলে ৩৮ বছরের কর্মজীবন শেষ করে ১৯৯৫ সালের গোড়ায় অবসর নিয়েছিলেন তিনি। এর কিছু দিনের মধ্যেই তুলো থেকে পোশাক তৈরির ঐতিহ্যশালী কম্পোজিট সুতো কলটিতে তালা ঝোলে। হাজার তিনেক শ্রমিকের প্রাপ্য বাবদ গ্র্যাচুইটির টাকাও বন্ধ ছিল তখন থেকেই। ইউনিয়ন গড়ে সেই ন্যায্য হক আদায়ের লড়াইয়ে নামলেও সে টাকা কোনওদিন সত্যিই হাতে আসবে সে দুরাশা ছেড়েই দিয়েছিলেন মদনমোহন।
এখন ৮৭ বছরের বৃদ্ধ পুজোর আগে অভাবনীয় ভাবে নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রাপ্য টাকা ঢুকতে দেখেছেন। পশ্চিমবঙ্গে কয়েক দশক ধরে অজস্র কারখানা বন্ধের ইতিহাসে এত বছর বাদে শ্রমিকের প্রাপ্য টাকা উদ্ধারের নমুনা রীতিমতো বিরল। শ্রমিক আন্দোলনের পোড়খাওয়া নেতারাও তা সচরাচর ঘটতে দেখেননি।
রবিবার সকালে বাউড়িয়ার বাড়িতে ছ’ছেলের বাবা মদনমোহন ঈষৎ থেমে থেমে বলছিলেন, “১৯৫৭-র ২০ মে থেকে ১৯৯৫-এর পয়লা জানুয়ারি অবধি চাকরি করেছি। ৮০ টাকা ৯০ পয়সা হিসাবে এত বছরের ১৫ দিন করে আয়ের টাকা সুদ সমেত ডবল হয়েছে। রিটায়ার হওয়ার ২৭ বছর বাদে পেলাম মোট ৯২ হাজার ২২৬ টাকা। পুজোর দু’দিন আগে আমার কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে সবটা টাকা ঢুকতে বড়ই আনন্দ পেয়েছি।”
একই সঙ্গে শিকে ছিঁড়েছে আরও ৩১ জনেরও। তাঁদের মধ্যে প্রয়াত রবিরাম দাসের স্ত্রী ৭০ বছরের পদ্মও রয়েছেন। বাউড়িয়ার শ্রমিকদের গড়ে তোলা সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা কুশল দেবনাথ বলছেন, “৩১ জন টাকা হাতে পেয়েই গেছেন। আরও জনা তিরিশের বিষয়ে সহকারী শ্রম কমিশনারের কাছে শুনানিও সারা হয়েছে। নিয়মমাফিক বাউড়িয়া কটন মিলের সব শ্রমিকের গ্র্যাচুইটির টাকা পাওয়ার কথা।”
তিন দশক বাদে কী ভাবে ঘটল এই প্রাপ্তিযোগ? শ্রমিকেরা এত দিন ধরে লেগে থাকা আন্দোলনকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। একদা ভারতের বৃহত্তম সুতোকলটি বন্ধ হওয়ার পরে ঋণ উদ্ধার তথা ডেট রিকভারি ট্রাইবুনালের (ডিআরটি) আওতায় চলে যায়। শ্রমিকেরাও নিজেদের পাওনাগণ্ডার লড়াই চালাতে থাকেন। ২০১১ সালে কারখানাটি নিলাম হয়ে ৩১ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছিল। নানা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে এই ডিআরটিতে ৩১ কোটির মধ্যে ১৬ কোটি শ্রমিকদের প্রাপ্য বলে ধার্য হয়। ২০১৭ সালে শ্রম দফতরে সেই টাকার মধ্যে থেকে প্রাপ্যের লড়াই শুরু করেন শ্রমিকেরা।
সব দাবির নিষ্পত্তি হতে সময় লেগেছে বলে জানাচ্ছেন শ্রম দফতরের কর্তারা। তা ছাড়া, কোভিড পর্বে টাকা ফেরতের প্রক্রিয়া আরও খানিকটা থমকে যায়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অনেকেরই মুখে হাসি ফুটেছে। কারখানা বিক্রির পরে নতুন কিছু এখনও শুরু না-হলেও পুরনো শ্রমিকদের কেউ কেউ সঙ্কট থেকে দেরিতে হলেও খানিকটা রেহাই পেলেন। প্রাপ্য টাকার সঙ্গে ছেলেদের সংসারে এই প্রবীণ বয়সে অনেকটা বাড়তি মর্যাদাও পেয়েছেন মদনমোহন। ছেলেরাও শ্রমিক। টানাটানির সংসার। অনেক দিন ধরে পড়ে থাকা পুরনো ঘরদোর রং করানোরও ইচ্ছে রয়েছে মদনমোহনের। এত বয়সে জীবনে এমন বিশেষ ঘটনা ঘটা তাঁরও স্বপ্নের অতীত ছিল যে।