বাবা-মাকে খুনের পরে বোনকে ফোন অবিনাশের

রবিবার বিকেলে ফানিয়ামারা গ্রামের নতুন পাকা বাড়িটার রান্না ঘরে এঁচোড় ও ঝিঙের টুকরো গুলো শুকিয়ে গিয়েছে। পেশায় পুলিশ কর্মী ছেলে আচমকা বাড়ি আসায় তরিবত করে রান্নার আয়োজন করছিলেন দীপালি পাত্র। কয়েক দিন আগে দীপালিদেবীর বাঁ হাত ভেঙে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনি নতুন রান্নাঘরে কুটনো কুটছিলেন। ছেলে পুলিশে চাকরি পাওয়ার পরে টালির ছাদের বিবর্ণ মাটির বাড়িটার সামনের জমিতে সদ্য একতলা নতুন বাড়ি তৈরি হয়েছে। অক্ষয় তৃতীয়ায় নতুন বাড়ির গৃহপ্রবেশও হয়েছে।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

গোপীবল্লভপুর শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৫ ০৩:৩৪
Share:

পড়ে রয়েছে অবিনাশের বাবা-মার দেহ।

রবিবার বিকেলে ফানিয়ামারা গ্রামের নতুন পাকা বাড়িটার রান্না ঘরে এঁচোড় ও ঝিঙের টুকরো গুলো শুকিয়ে গিয়েছে। পেশায় পুলিশ কর্মী ছেলে আচমকা বাড়ি আসায় তরিবত করে রান্নার আয়োজন করছিলেন দীপালি পাত্র। কয়েক দিন আগে দীপালিদেবীর বাঁ হাত ভেঙে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনি নতুন রান্নাঘরে কুটনো কুটছিলেন। ছেলে পুলিশে চাকরি পাওয়ার পরে টালির ছাদের বিবর্ণ মাটির বাড়িটার সামনের জমিতে সদ্য একতলা নতুন বাড়ি তৈরি হয়েছে। অক্ষয় তৃতীয়ায় নতুন বাড়ির গৃহপ্রবেশও হয়েছে।

Advertisement

এ দিনের ঘটনা অবশ্য পুরনো মাটির বাড়িতেই হয়েছে। পড়শিরা জানান, দুপুর বারোটা নাগাদ দীপালিদেবী তখন রান্নাঘরে ছিলেন। তাঁর স্বামী বালকবাবু ছিলেন পিছনের মাটির বাড়িতে। পড়শিরা শুনতে পান, বাবা-ছেলের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। ঝগড়া থামাতে ছুটে যান দীপালিদেবী। তারপরই মাটির বাড়িটার ভিতর থেকে পর পর গুলির আওয়াজ। ইনসাস বন্দুক হাতে আগুন চোখে অবিনাশের হুমকির মুখে পড়শি-স্বজনদের কেউই বাড়িতে ঢুকে গুলিবিদ্ধ পাত্র দম্পতিকে উদ্ধার করতে পারেননি। এগোনোর চেষ্টা করলেই শূন্য গুলি ছুড়ে ভয় দেখিয়েছে অবিনাশ। এলাকায় আপাত শান্ত হিসেবে পরিচিত মেদিনীপুর পুলিশ লাইনের জুনিয়র কনস্টেবল অবিনাশ যে এভাবে বাবা-মা’কে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন তা মেনে নিতে পারছেন না কেউই। খবর পেয়ে ছুটে আসেন গোপীবল্লভপুরের বিডিও অনন্য জানা। তাঁর কথায়, “এমন নৃশংস ভাবে কেউ নিজের বাবা-মা’কে কেউ খুন করতে পারে, ভাবা যায় না।”

বাবা-মা’কে খুন করার কিছু সময় পরে মাটির বাড়ির দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেন অবিনাশ। গোপীবল্লভপুর থানার আইসি মণিময় সিংহ রায়ের আবেদনেও দরজা খোলেন নি তিনি। ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অজিত সিংহ যাদব বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘিরে ফেলেন গোটা বাড়ির চারপাশ। তার আগে বন্ধ ঘরের ভিতর বার কয়েক গুলি আওয়াজ পেয়েছিল পুলিশ। বন্দুক উঁচিয়ে পুলিশ বাহিনী চারপাশে থেকে সন্তর্পণে এগোচ্ছিল। আশেপাশের বাড়ির ছাদ থেকেও দূরবিনে নজরদারি চালাচ্ছিল পুলিশ। ওদিকে ঝাড়গ্রামের নেতুরা গ্রামে ববিতা গিরি নিজের মোবাইলে দাদার ফোন পান। বাবা-মাকে খুন করার কথা বোনকে জানিয়ে দেন অবিনাশ। তারপর বার বার দাদার মোবাইলে ফোন বেজে গিয়েছে। ববিতা যখন পৌঁছন তখন সব শেষ হয়ে গিয়েছে। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ অবিনাশের গুলিবিদ্ধ দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মেদিনীপুরে নিয়ে যাওয়ার পথে অবিনাশের মৃত্যু হয়। বাবা-মা ও দাদাকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে ববিতা এ দিন কোনও কথা বলতে পারেননি। ববিতার স্বামী পুলকেশ গিরি বলেন, “শ্যালকের বিয়ের দেখাশোনা চলছিল। মেদিনীপুরের মির্জাবাজারে একটি মেয়ে দেখা হয়েছিল।” তারপর চুপ করে যান পুলকেশবাবু। অবিনাশের এক আত্মীয় বলেন, “বাড়ির পছন্দ করা মেয়েটিকে বিয়ে করতে অবিনাশের আপত্তি ছিল। অবিনাশ অন্য একটি মেয়েকে ভালবাসত। সেটা অভিভাবকরা মানেননি।”

Advertisement

অবিনাশের বন্ধু ফানিয়ামারার স্বপন মান্না বলেন, “এ দিন সকাল এগারোটায় বাড়ির সামনে অবিনাশের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বলল ক’দিন থাকবে। তখন কোনও অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করিনি। কোথা থেকে কী হয়ে গেল।”


তখনও রয়েছে রক্তের দাগ।

খবর পেয়ে আসেন গোপীবল্লভপুরের বিডিও অনন্য জানা। গোপীবল্লভপুরের আইসি মণিময় সিংহ রায় ও ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অজিত সিংহ যাদব পুলিশ বাহিনী নিয়ে পৌঁছন। পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকে অবিনাশের উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পন করার অনুরোধও করা হয়। জবাবে বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে কয়েক বার গুলির আওয়াজ শোনা গিয়েছিল। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ দরজা ভেঙে বাড়ির ভিতরে ঢুকে বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অবিনাশকে উদ্ধার করে পুলিশ। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। বালকবাবু ও তাঁর স্ত্রী পেশায় স্বাস্থ্যকর্মী দীপালিদেবীর মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তে পাঠানো হয়। মৃতদেহে একাধিক গুলির ক্ষত ছিল। এ ছাড়া কোপানোর দাগও ছিল।

স্থানীয় সূত্রে খবর, কয়েক দিন আগে অবিনাশের প্রেমিকার বাবা-মা ওই যুবকের বাড়িতে বিয়ের কথা বলতে এসেছিলেন। কিন্তু প্রেমিকার অভিভাবকদের সঙ্গে অবিনাশের বাবা-মা দুর্ব্যবহার করেন। অবিনাশ এটা মেনে নিতে পারেননি। তা নিয়ে খেপেও ছিলেন। অনুমান, তার জেরেই বাবা-মাকে খুনের পরিকল্পনা করেন তিনি।

দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement