গৌতম চট্টোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
হুগলির এক গ্রামে অ্যাসবেসটসের চাল ছাওয়া ঘর। সব সময় জুটত না পেট ভরা খাবারও। এক বছরের ছোট ভাই বুদ্ধদেবকেও তাঁর সঙ্গে এক ক্লাসে ভর্তি করা হয়েছিল। কারণ, আলাদা করে দু’জনকে বই কিনে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না বাড়ির। খালি পেটে ঘুম আসত না বলে রাতে জেগে শুয়ে স্বপ্ন দেখতেন। তার পর থেকে তাঁর উড়ানও স্বপ্নেরই মতো। শেষে এসে পৌঁছলেন নাসা-তে। শুরু করলেন ভিন্ গ্রহে প্রাণ আছে কি না, তাই নিয়ে গবেষণা।
হুগলির ছেলে, বিজ্ঞানী গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে এ বছর ‘নাসা-জেপিএল প্রপালশান ল্যাবরেটরি পিপল লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’-এর জন্য মনোনীত করেছেন নাসা কর্তৃপক্ষ।
গৌতমের দাদু-ঠাকুমা বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে এসেছিলেন। মার্কিন মুলুক থেকে হোয়াটসঅ্যাপ কলে গৌতম জানালেন, কোন্নগর স্টেশনের কাছে নবগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় মাটির মেঝে, অ্যাসবেসটসের চালের ছোট একটি ঘরে বাবা-মা, ছয় ভাইবোনের সংসার ছিল তাঁদের। বাবা সুনীলরঞ্জন সরকারি চাকরি করতেন। উপার্জন অল্প। ফি দিতে না পারায় তৃতীয় শ্রেণিতে পরীক্ষার হল থেকে তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মায়ের অনুনয়ে বাকি পরীক্ষা দিতে পারেন। একটি পরীক্ষা না-দিয়েও দ্বিতীয় হন। তত দিনে এক বছরের ছোট ভাই বুদ্ধদেবকে এক ক্লাস উঁচুতে ভর্তি করা হয়েছিল, যাতে এক বইতেই দু’জনের চলে। হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করেছেন। বিদ্যুৎ আসে, যখন তিনি নবম শ্রেণি।
তবে মেধাবী গৌতমকে আটকে রাখতে পারেনি কোনও বিরুদ্ধতাই। শিবপুর বিই কলেজে ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়াশোনা সেরে, টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে (টিআইএফআর) যোগ ‘জায়ান্ট মেট্রোওয়েভ রেডিয়ো টেলিস্কোপ’ তৈরিতে। গোবিন্দ স্বরূপ, জয়ন্ত নারলিকরদের মতো বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে আসেন। শেষে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা ক্যালটেক। তার পরেই নাসা থেকে ডাক। ১৯৯৯ সালে সেখানে যোগ দেন। এর মধ্যে স্টিফেন হকিংয়ের পাশে বসেও কাজ করেছেন। গৌতম বলেন, ‘‘ওঁর পাশে বসে কাজ করছি, অবাক লাগত।’’
সেই নাসা-ই এ বারে সম্মানিত করছে গৌতমকে। ওই পুরস্কারের মাধ্যমে তাঁকে স্বীকৃতি দিচ্ছে প্রযুক্তিগত নেতৃত্বের পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যও। আগামী মাসে তাঁকে ওই পুরস্কার দেওয়া হবে।
আমেরিকায় পরিবেশবিজ্ঞানী স্ত্রী সুলেখা ও কলেজপড়ুয়া মেয়ে অনুরিমাকে নিয়ে থাকেন গৌতম। বাবা মারা গিয়েছেন। মা সাধনা চট্টোপাধ্যায় কোন্নগরের ক্রাইপার রোডের বাসিন্দা। বিদেশে থেকেও মাটির টান অটুট গৌতমের। তাঁর কথায়, ‘‘সুযোগ পেলেই বাড়ি যাই। আমেরিকাতেও ভাত-ডাল-মাছেই অভ্যস্ত। আপাদমস্তক বাঙালি।’’
পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের রমরমার কথা তুলে গৌতম বলেন, ‘‘আমি কিন্তু বাংলা মাধ্যমের ছাত্র। সব ঘরে সিমেন্টের মেঝে ছিল না। দামি ব্ল্যাকবোর্ডও ছিল না। কিন্তু শিক্ষকেরা ভাল ছিলেন। ওঁরা শ্রদ্ধেয়।’’ নিজের জীবনের কথা উঠলে দার্শনিক বনে যান বিজ্ঞানী। বলেন, ‘‘খালি পেটে ঘুম আসে না। সেই চোখে স্বপ্ন দেখা সহজ। তাতে পয়সা লাগে না। তাই দেদার স্বপ্ন দেখতাম। যে দিন নাসায় যোগ দিলাম, দুর্দান্ত অনুভূতি। এখনও একই উত্তেজনা টের পাই। মনে হয়, প্রত্যেক দিন কাজের প্রথম দিন।’’
আর গবেষণা? গৌতম বলেন, ‘‘অন্য গ্রহে প্রাণ আছে কি না, তা জানতে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হচ্ছে এবং হবে। নতুন যন্ত্র বানাতে হবে, যেটা গিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধান চালাবে।’’
যদি সফল হন, তা হলে তাঁর স্বপ্নের উড়ানে যোগ হবে আর এক নতুন ডানা।