অস্ত্রোপচারের পরে।
কান বলে কিছু নেই। কানের জায়গায় ছোট্ট গর্ত। আর তা থেকে ঝুলছে ছোট্ট মাংসপিণ্ড।
বছর বারোর মেয়েটি সঙ্কোচে স্কুল যেতে পারত না। সহপাঠীরা সবাই খেপাত যে। এক সময় বাড়ি থেকেই বেরোতে চাইত না সে। বেরোলেই লোকে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করত। গ্রামের বাড়ির এক চিলতে ঘরে গুমরে দিন কাটত তার। মেয়ের ওই অবস্থা দেখে বাবা-মাও বুঝে উঠতে পারতেন না কী করবেন। একাধিক হাসপাতালে গিয়েও বিফল হয়ে ফিরতে হয়েছে বারবার। শেষ পর্যন্ত কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে এসে নতুন অঙ্গ পেল তাঁদের সন্তান। বুকের কাছ থেকে কার্টিলেজ নিয়ে চিকিৎসকেরা তৈরি করে দিলেন নকল কান। আপাতত সেই কান নিয়েই ছন্দে ফিরেছে ওই কিশোরীর জীবন।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে ‘ইনার ইয়ার’ অর্থাৎ কানের ভিতরের অংশ তৈরি হয় না। সে ক্ষেত্রে ককলিয়র প্রতিস্থাপন করে শ্রবণশক্তি ফেরানো হয়। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রে আবার কানের বাইরের অংশটিই অসম্পূর্ণ থাকে। এ ক্ষেত্রে শোনার সমস্যার পাশাপাশি চেহারাগত বিকৃতির জন্য থাকে লোকলজ্জা। স্বাভাবিক জীবনে কিছুতেই থাকতে পারে না এই শিশুরা। যেমনটা হয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরে মিনি সাধুখাঁর (নাম পরিবর্তিত)। তার ক্ষেত্রে বাড়তি সমস্যাও ছিল। এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সাধারণত এই ধরনের অস্ত্রোপচার ছ’থেকে আট বছরের মধ্যে হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ কানের ৮০ শতাংশ নির্মাণই আট বছরের মধ্যে হয়ে যায়। বয়স যত বাড়তে থাকে, শরীরের নরম হাড় বা কার্টিলেজও শক্ত হয়ে যায়। অঙ্গ নির্মাণ করা সমস্যার হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: ফের শিশুমৃত্যু, মা-বাবাকেই দুষলেন যোগী
কিন্তু সচেতনতা আর সঠিক দিশার অভাবেই মিনির অস্ত্রোপচারের জন্য কোথায়, কী ভাবে যোগাযোগ করতে হবে, বুঝতে পারেনি তার পরিবার। ফলে তাঁরা যখন এসএসকেএমে পৌঁছন, তখন মিনির বয়স ১৩ বছর। তাই আদৌ অস্ত্রোপচার সম্ভব কি না, হলেও তা কত দূর সফল হবে, এ সব নানা সংশয় ছিল। একটু ঝুঁকি নিয়েই পিজি-র প্লাস্টিক সার্জেন অরিন্দম সরকার অস্ত্রোপচার করেন। আপাতত ঝুঁকি কাটিয়ে সুস্থ মিনি।
অস্ত্রোপচারের আগে এই অবস্থাই ছিল কিশোরীর।
অরিন্দমবাবু জানিয়েছেন, এই ধরনের অস্ত্রোপচার কয়েকটি ধাপে করতে হয়। সব মিলিয়ে প্রায় বছর দেড়েক সময় লাগে। মিনির ক্ষেত্রে বাইরের সমস্যার সঙ্গে ভিতরে অর্থাৎ কানে শোনার ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা ছিল। চিকিৎসা হয়েছে সেই সবেরও।
অস্ত্রোপচারের পরে মিনি বলছিল, ‘‘আগে বাড়ি থেকে বেরোতে ভয় করত। এখন যতটা পারি চার পাশটা ঘুরে দেখি। অনেক কথা বলি। গান গাইতে ইচ্ছে করে, শুনতে ইচ্ছে করে।’’
চিকিৎসকেরা জানান, কানে শোনার ক্ষেত্রে সমস্যা থাকলে ককলিয়র প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে। এসএসকেএমের ইএনটি বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক অরুণাভ সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, যারা জন্ম থেকেই সম্পূর্ণ বধির, তাদের পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে ককলিয়র প্রতিস্থাপন করা যায়। আর হঠাৎ কোনও অসুস্থতার কারণে সম্পূর্ণ বধির হয়ে গেলে, ১২ বছর বয়স পর্যন্ত এই প্রতিস্থাপন করা যায়।
তিনি বলেন, ‘‘ছ’মাসে এসএসকেএমে আমরা ২৩ জনের ককলিয়র প্রতিস্থাপন করেছি। ২২টি ক্ষেত্রেই সফল। বেসরকারি ক্ষেত্রে এই ধরনের অস্ত্রোপচারে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়। সরকারি হাসপাতালে সেটাই হচ্ছে নিখরচায়। যে শিশুদের জীবনটা শব্দহীন, তাদের শব্দের জগতে ফিরিয়ে দেওয়ার তৃপ্তিটাই অন্য রকম।’’