সেরা ভাণ্ডারী। দিল্লিতে পুরস্কার হাতে শুকদেব নাথ।ফাইল চিত্র
বন্যা যেমন ভাঙে, তেমন গড়েও দেয়।
১৯৮৬ সালের বানে ভাসছে সাগরদ্বীপের প্রত্যন্ত এলাকা। সকলে ক্ষতির খতিয়ান নিয়ে ব্যস্ত। সাগর ব্লকের কৃষ্ণনগরে শুকদেব নাথ কিন্তু তখন অন্য হিসেব কষছিলেন।
সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে তখন সংকর বীজের রমরমা। অথচ উচ্চফলনশীল সেই ধান গাছ সইতে পারেনি নোনা জলের ঝাপটা। বন্যা বিধ্বস্ত সাগরে সংকর ধানের ধ্বংসস্তূপের মাঝে যে গুটিকতক ধান গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল সেগুলো ছিল দেশি।
বছর পঞ্চাশের শুকদেববাবুর লড়াইটা শুরু হয় সে দিন থেকেই। হারিয়ে যাওয়া দেশি ধান সংরক্ষণের লড়াই। দীর্ঘ তিন দশক পরে যার ফসল ঘরে তুলেছেন তিনি। কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর লড়াইকে স্বীকৃতি দিয়েছে। পেয়েছেন সেরার শিরোপা।
বর্তমানে সমবায় সমিতি গড়ে হারিয়ে যাওয়া সুগন্ধি ধান সংরক্ষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন শুকদেববাবু। এই কাজে সমিতিকে সাহায্য করছে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বিসিকেভি)। প্রায় ৩৯ রকম সুগন্ধি ধানের বীজ শুধু খুঁজেই বেরই করেননি, শুকদেববাবুরা সেগুলো চাষও করছেন। এমন একটি সুগন্ধি ধানের বীজ তিনি খুঁজে বের করেছেন, কৃষিবিজ্ঞানীরা সর্বশেষ যার দেখা পেয়েছিলেন দেড়শো বছর আগে। বিসিকেভি-র উপাচার্য ধরণীধর পাত্র বলেন, ‘‘শুকদেববাবু এমন সম্মান পাওয়ায় আমরা খুশি।’’
শুরুতে লড়াইটা ছিল শুকদেববাবুর একার। সম্বল বলতে নিজেদের সামান্য কয়েক কাঠা জমি। লুপ্তপ্রায় ধানের খোঁজে তিনি চষে বেরিয়েছেন রাজ্যের নানা প্রান্ত। চাষিদের কাছ থেকে জোগাড় করেছেন বীজ। ২০১১ সালে গড়ে ওঠে চাষিদের সমবায় সমিতি। চাষিদের ৫৪টি দল তৈরি করে ৩০০ বিঘা জমিতে ফলছে হারিয়ে পাওয়া সুগন্ধি ধান।
বিসিকেভি-র কৃষিবিজ্ঞানীদের সঙ্গে শুকদেববাবুর আলাপ হয় রামকৃষ্ণ মিশনের মাধ্যমে। বিসিকেভি-র অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ জানান, তাঁদের হারানো সুগন্ধি ধান নিয়ে প্রকল্প রয়েছে। খুঁজতে খুঁজতে শুকদেববাবু এমন একটি ধানের বীজ পেয়েছিলেন, যা এতদিন লুপ্ত বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল।
গোবিন্দভোগের থেকে আকারে বড়, কিন্তু মিনিকিটের থেকে ছোট হরিণখুড়ি নামের সুগন্ধি, মাঝারি মাপের ধানটি প্রায় দেড়শো বছর আগে লুপ্ত হয়েছিল বলেই মনে করা হতো। শুকদেববাবু জানান, গাঙ্গেয় উপকূলের কিছু এলাকায় দু’-এক জন চাষি বংশ পরম্পরায় ওই হরিণখুড়ির ধানের চাষ করতেন। শুকদেবেরবাবুর মাধ্যমে বিসিকেভি-র বিজ্ঞানীরা ধানটিকে চিহ্নিত করেন।
আরও পড়ুন: দিনেদুপুরে বাড়ি ঢুকে বৃদ্ধাকে মারধর করে লুঠ
সমিতি এই পুরস্কার পেতে পারে। সমিতিকে নাম নথিভুক্ত করাতে হয় কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে।
বিসিকেভি ২০১২ সালে শুকদেববাবুর কাছ থেকে বীজ নিয়ে সফল ভাবে ধান চাষ করেছিল। ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের পুরস্কারের জন্য শুকদেববাবুর সমবায় সমিতির নাম নথিভুক্ত করে বিসিকেভি। কৃষি মন্ত্রকও ওই ধানের বীজ দিয়ে চাষ করে সাফল্য পায়। ২০১৬ সালের জুন মাসে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের একটি দল সাগরদ্বীপে আসে। কৃষ্ণনগরে এসে ধান চাষ এবং বীজ সংরক্ষণের পদ্ধতি দেখে যায় তারা। মাটির কলসি, খড়ের তৈরি পাত্রে ধান সংরক্ষণ পদ্ধতির তারিফ করে যান কৃষি মন্ত্রকের ওই আধিকারিকেরা।
গত বছর ডিসেম্বরে কৃষি মন্ত্রক থেকে শুকদেববাবুকে জানানো হয় পুরস্কার পাচ্ছেন তাঁরা। ২১ ডিসেম্বর দিল্লিতে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী রাধামোহন সিংহের হাত থেকে পুরস্কার নেন শুকদেববাবু-সহ সমবায় সমিতির সদস্যেরা। কেন্দ্রীয় কৃষি জিন ব্যাঙ্ক শুকদেববাবুর খুঁজে পাওয়া ৩৯ রকমের বীজ সংরক্ষণের জন্য নিয়েছে।
একটা সময় হারিয়ে যাওয়া বীজ খুঁজে পাওয়াই নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর। এখন তৃপ্তির হাসি প্রবীণ বীজ-সন্ধানীর মুখে। পুরস্কার হিসেবে কৃষি মন্ত্রক থেকে পাওয়া ১০ লক্ষ টাকা বীজ সংরক্ষণে খরচ করতে চান শুকদেববাবু। বললেন, ‘‘দেশি জিনিসের কোনও বিকল্প হয় নাকি! তা বাঁচিয়ে রাখার কাজটাও জরুরি।’’