ঘূর্ণিঝড় রেমালের পর পরিস্থিতি। ছবি: পিটিআই।
টানা ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টিতে জল থইথই কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলা। কয়েকটি জায়গায় ঝড়ে বাড়ি ভেঙে পড়ে মৃত্যুর খবরও এসেছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজ্যে ছ’জনের প্রাণহানির খবর মিলেছে। তার মধ্যে রয়েছেন কলকাতার এক, পূর্ব বর্ধমানের দুই এবং উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার তিন জন বাসিন্দা। ঝড়ের তাণ্ডবে গাছ ভেঙে কলকাতার পাঠভবন স্কুল ভবনের একটি দেওয়াল ভেঙে গিয়েছে। কলকাতার বিভিন্ন রাস্তা এখনও জলবন্দি। কয়েকটি রাস্তায় এখনও হাঁটুজল জমে রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় চলছে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি। ঘূর্ণিঝড় রেমালের পর রাজ্যের নানা জায়গার খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর
দিঘা, রামনগর থেকে খেজুরি-সহ পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী এলাকায় রেমালের প্রভাবে কমবেশি ক্ষয়ক্ষতির খবর মিলেছে। বিকেলের পর দিঘায় সমুদ্র খানিক শান্ত হয়েছে। হলদি নদী যে ভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছিল, সে-ও শান্ত হয়েছে অনেকটা। তবে আতঙ্কে রয়েছেন উপকূলবর্তী এলাকার বাসিন্দারা। ইতিমধ্যে বেশ কিছু জায়গায় সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে গিয়েছে চাষের জমিতে। বিশেষত, হলদিয়ায় এই ক্ষতির পরিমাণ বেশি বলে জানা গিয়েছে। এখনও বেশ কিছু এলাকা বিদ্যুৎহীন। পশ্চিম মেদিনীপুরেও টানা বৃষ্টি চলছে। তবে ঝড়ের তাণ্ডব খানিক স্তিমিত হয়ে এসেছে। বড় কোনও ক্ষয়ক্ষতির খবর না-মিললেও বেশ কিছু জায়গায় বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে বিভিন্ন জায়গায়।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা
প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনার চট্টামাঝের পোলে দুই নাবালক বন্ধু পুকুরে স্নান করতে গিয়ে জলে তলিয়ে যায়। মৃত্যু হয় এক জনের। কালীতলা আশুতি থানার চট্টামাঝের পোল এলাকার ঘটনা। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃতের নাম আনসারুল খান (১৫)। তার বাড়ি শিলিগুড়ি ইসলামপুরে। কর্মসূত্রে বাবা-মা দক্ষিণ ২৪ পরগনায় থাকেন। মহেশপুরের নুঙ্গিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে এক মহিলার। মৃতার নাম তাপসী দাস (৫৩)। তিনি মহেশতলা পুরসভার ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। গোসাবার রাঙাবেলিয়াতে গতকাল রাতে গোমর নদী বাঁধে বেশ কিছু জায়গায় ধস নামে। আতঙ্কিত হয়ে পড়েন গ্রামবাসীরা। সকাল থেকে সেই নদী বাঁধে প্লাস্টিক ও ত্রিপল দিয়ে বাঁধ মেরামতির কাজ শুরু করেন তাঁরা। উপস্থিত ছিলেন গোসাবা পঞ্চায়েত সমিতির সহকারী সভাপতি কৈলাস বিশ্বাস। কিন্তু নতুন করে জলস্তর বেড়ে নদী বাঁধ ভেঙে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় আতঙ্কিত এলাকাবাসী। অন্য দিকে, মৌসুনি দ্বীপে বাগডাঙা এলাকায় বড় গাছ ঘরে পড়ে ঘরের মধ্যে থাকা রেণুকা মণ্ডল নামে এক মহিলা মারা যান। বাড়ির চাল ভেঙে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ঘূ্র্ণিঝড়ের পর সোনারপুর পুরসভার একাধিক অঞ্চল বিদ্যুৎহীন। বিভিন্ন জায়গায় ইলেকট্রিক তারের উপর গাছ পড়ে যাওয়ায় এই সমস্যা। দিনভর পুরসভার কর্মীরা নানা জায়গায় গাছ কাটার কাজ করেছেন। রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার চেয়ারম্যান পল্লবকুমার দাস বলেন, ‘‘জল জমার অভিযোগ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে বিদ্যুৎ না থাকায় পানীয় জল সরবরাহের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। বিভিন্ন পাম্পিং স্টেশনে বিকল্প জেনারেটরের ব্যবস্থা করে এই পরিষেবা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সোমবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার আমতলায় নির্বাচনী প্রচারে কর্মসূচি বাতিল করেন ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল প্রার্থী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তবে আমতলার একটি ত্রাণ শিবিরে গিয়ে সেখানে আশ্রয় নেওয়া মানুষজনের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
উত্তর ২৪ পরগনা
রেমালের দাপটে একটি বড় গাছ উপড়ে পড়েছে যশোর রোডে। তাতে কারও ক্ষয়ক্ষতি অবশ্য হয়নি। গাছ কেটে রাস্তা পরিষ্কারের কাজ শুরু হয় দুপুরে। তবহে এ জন্য প্রায় তিন ঘণ্টা যশোর রোডে যানজট ছিল। রেমালের দমকা হাওয়ায় পর পর রাখা আটটি উপর ভেঙ্গে পড়ে বরানগর বেঙ্গল ইমিউনিটি কারাখানার ৭০ ফুটের একটি চিমনি। সবকটি গাড়িই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘটনাস্থলে বরানগর থানার পুলিশ।
ঝড়ের দাপটে উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদের বরুণহাটে ইছামতী নদীর ধারে বসবাসকারী অনেকের বাড়ি সম্পূর্ণ এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিবার নিয়ে বাড়িছাড়া হয়েছেন জাহানরা গাজি নামে এক বাসিন্দা। জোয়ারের জল বাড়তে থাকায় গ্রামে জল ঢোকার পরিমাণ এবং বাঁধ ভাঙার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়েরা। সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জের মতো বেশ কিছু জায়গায় একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
হাওড়া
ঘূর্ণিঝড় রেমাল এবং টানা বর্ষণের জেরে ব্যাহত হাওড়া স্টেশন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ট্রেন চলাচল। রেল সূত্রে খবর, টিকিয়াপাড়া রেল ইয়ার্ডে লাইনে জল জমে যাওয়ার কারণে এই বিপত্তি। সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত হাওড়া-পাঁশকুড়া, হাওড়া-মেচেদা আপ এবং ডাউনের ছ’টি লোকাল ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। যদিও এখনও পর্যন্ত হাওড়া-দিঘা আপ এবং ডাউন, তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেস ছাড়া আর কোনও দূরপাল্লার ট্রেন বাতিল হয়নি। দক্ষিণ-পূর্ব রেল সূত্রে খবর, পাম্প চালিয়ে রেললাইন থেকে জল নামানোর চেষ্টা চলছে। বৃষ্টি না থামলে আরও ট্রেন বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা।ঘূ
ঘূর্ণিঝড় রেমলের পর বাংলায় ‘বলি’ ছয়! গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
হুগলি
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে হুগলিতে নষ্ট হয়েছে চাষবাস। জিরাট গ্রাম পঞ্চায়েতে গঙ্গাপারের শতাধিক মানুষকে সরিয়ে এনে রাখা হয়েছে ত্রাণ শিবিরে। আপাতত আশুতোষ স্মৃতি মন্দির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে। চর খয়রামারি এলাকার খাসেরচরের বাসিন্দাদের বর্তমান ঠিকানা ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়। ঝড়ের প্রভাবে গঙ্গার জলের পরিমাণ বেড়েছে। সঙ্গে বইছে দমকা হওয়া। হুগলির গঙ্গা পারের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা বাড়ছে প্রশাসনের। এখনও পর্যন্ত রেমালের প্রভাবে জেলায় ক্ষয়ক্ষতিতে প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন, তা জানতে হুগলির জেলাশাসক দফতরে যান বিদায়ী সাংসদ তথা এ বারের বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়। হুগলির অতিরিক্ত জেলাশাসক তরুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করে লকেট জানান, ঘরবাড়ি থেকে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নির্বাচন আচরণবিধি এখনও চালু রয়েছে। লকেট বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে শুধু প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে পারে। জেলা প্রশাসন কী ভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়াবে, তা নিয়ে আলোচনা করেছি। কোথায় কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব প্রশাসন করবে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘চুঁচুড়া, বলাগড়, চন্দননগর-সহ বিভিন্ন জায়গায় যে ক্ষতি হয়েছে, তার তথ্য সংগ্রহ করে আমরা জেলা প্রশাসনকে দেব।’’
বর্ধমান
পূর্ব বর্ধমানের মেমারিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে বাবা ও ছেলের। মৃতদের নাম ফড়ে সিংহ (৬৪) এবং তরুণ সিংহ (৩০)। মৃতদের পরিবার সূত্রে খবর, ঝড়ে ভেঙে পড়া কলাগাছ কাটতে গিয়ে বিদ্যুৎবাহী তারের সংস্পর্শে গিয়ে ওই দুর্ঘটনা হয়। আবার মেমারিতই ঝড়ে উপড়ে পড়া ইলেকট্রিকের খুঁটি টপকে যেতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে একটি চার চাকার গাড়ি। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তা থেকে গাড়িটি পড়ে যায় সেচখালে। তবে বরাত জোরে রক্ষা পেয়েছেন গাড়ির চালক-সহ যাত্রীরা। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, চার চাকা গাড়িটি মোগলমারি থেকে বাঁকুড়ার ইন্দাসের দিকে যাচ্ছিল। আপাতত ঝোড়ো হাওয়া কমেছে। তবে ঝিরঝিরে বৃষ্টি চলছে বর্ধমানের নানা জায়গায়।
বীরভূম
রাতভর ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি হয়েছে বীরভূমে। সোমবার বিকেল পর্যন্ত হালকা বৃষ্টি হয়েছে।
নদিয়া
তীব্র তাপপ্রবাহে বাগান বাঁচিয়ে রাখতে খরচ দিতে হয়েছে নিয়মিত জলসেচের। সবে বিক্রি শুরু হয়েছে জমির ফসলের। তার মধ্যেই ঝড়ের তাণ্ডবে সব লন্ডভন্ড। নদিয়ার করিমপুরে ঝড়ের তাণ্ডবে তছনছ হয়ে গিয়েছে বিঘার পর বিঘা কলাবাগান। মুনাফা তো দূরের কথা, সারা বছরের খরচ উঠবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় এখন জেলার কলাচাষিরা। জেলা উদ্যানপালন দফতর সূত্রে খবর, রাজ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ উৎপাদন নদিয়া থেকে আসে এবং রেমাল ঘূর্ণিঝড়ে এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র নদিয়া জেলায় আনুমানিক পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে কলাবাগানের ক্ষতি হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মুর্শিদাবাদ
রাতভর ঝড়ের পর সোমবার রেমালের শক্তি কমলেও সারা দিন ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি সমানে চলেছে মুর্শিদাবাদে। আম ও লিচু বাগানে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা জেলায়। অতিরিক্ত জলস্ফীতি দেখা গিয়েছে ভাগীরথীতে। বেশ কয়েকটি জায়গায় পার ভাঙার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সুতি-সমশেরগঞ্জের মতো একাধিক জায়গায় নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে ভাগীরথীতে। জেলা জুড়ে বেশির ভাগ জায়গায় বিপর্যস্ত বিদ্যুৎ পরিষেবা। জেলাশাসকের দফতরে ২৪ ঘন্টার জন্য খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। প্রস্তুত রাখা হয়েছে একাধিক বিপর্যয় মোকাবিলা দলকে। বিভিন্ন ঘাটে ফেরি চলাচলের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে প্রশাসন। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে গঙ্গা তীরবর্তী এলাকায়।
মালদহ
রেমালের প্রভাব পড়েছে মালদহেও। মানিকচকে খেয়া পারাপার বন্ধ ছিল সোমবারও। রবিবার রাতে হালকা ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। সোমবার সকালেও ঝোড়ো হওয়া এবং ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসনের তরফে বারবার নজরদারি চালানো হচ্ছে মানিকচক ঘাটে।
উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর
দক্ষিণবঙ্গের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের সব জেলাতেই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টি হয়েছে। সোমবার সকাল থেকে মেঘলা আকাশ। দুই দিনাজপুরে খুব ভারী বৃষ্টি না হলেও অস্বস্তিকর গরমের হাত থেকে খানিক স্বস্তি পেয়েছেন সাধারণ মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সোমবার সারা দিনই ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির কোনও খবর পাওয়া যায়নি। বরং আবহাওয়ার এই পরিবর্তন উপভোগ করেছেন দুই দিনাজপুরের মানুষ। রায়গঞ্জের তুলসীপাড়া এলাকায় জনস্বাস্থ্য কারিগারি দফতরের পাশে একটি গাছ উপড়ে পড়ে গিয়ে এক জন বাইকচালক আহত হওয়ার খবর মিলেছে।
কোচবিহার
রেমালের ছোঁয়ায় প্রচণ্ড দাবদহ থেকে রেহাই পেয়েছেন কোচবিহারবাসী। ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা থেকে বর্তমানে তাপমাত্রার পারদ নেমে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গিয়েছে। রবিবার মধ্যরাত থেকেই বিক্ষিপ্ত ভাবে কোচবিহার জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঝড় হয়। সঙ্গে ছিল মাঝারি বৃষ্টি। সোমবার হালকা বৃষ্টি হয়েছে। কোচবিহারের পরিবেশ এখন বেশ মনোরম।
দার্জিলিং
রাতে ঘণ্টাতিনেক বৃষ্টি হয়েছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির কোনও খবর নেই দার্জিলিং জেলায়। সোমবার ভোর থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল পাহাড়ে। তবে বৃষ্টি হয়নি। হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস, মঙ্গলবার পাহাড়-সহ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে বৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়বে।