তিন হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা জুটল না প্রৌঢ়ের

একটি দুর্ঘটনায় গলার নীচ থেকে শরীরের গোটা নিম্নাংশ অসাড় হয়ে গিয়েছে বছর বাহান্নর সুব্রত মজুমদারের। কলকাতার দুই নামী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা হাসপাতাল ফিরিয়ে দিয়েছে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৬ ০৪:৩৪
Share:

বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় পড়ে রয়েছেন সুব্রত মজুমদার। পাশে স্ত্রী আরতি দেবী। — নিজস্ব চিত্র।

একটি দুর্ঘটনায় গলার নীচ থেকে শরীরের গোটা নিম্নাংশ অসাড় হয়ে গিয়েছে বছর বাহান্নর সুব্রত মজুমদারের। কলকাতার দুই নামী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা হাসপাতাল ফিরিয়ে দিয়েছে। কেউ বলেছে, শয্যা নেই। কেউ জানিয়েছে, এমন গুরুতর আহতের চিকিৎসা করার মতো পরিকাঠামোই নেই তাদের। চিকিৎসা দূরে থাক, অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে ঘুরতে, শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এবং ওষুধ কিনতেই ১২ হাজার টাকার বেশি খরচা হয়ে গিয়েছে দরিদ্র পরিবারটির।

Advertisement

সপ্তাহখানেক হল পঙ্গু দশায়, কার্যত বিনা চিকিৎসায় সুভাষগ্রামের বাড়িতে পড়ে রয়েছেন পেশায় ক্যুরিয়র সংস্থার কর্মী, পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সুব্রতবাবু। পরিবারের কর্তা কী ভাবে ফের কাজে ফিরবেন, তা বুঝেই উঠতে পারছেন না তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে।

পরিবারের প্রশ্ন, যেখানে খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, গুরুতর আহত রোগীকে যে কোনও মূল্যে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে, সেখানে সুব্রতবাবু তার সুযোগ পাবেন না কেন? এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশও (পশ্চিমবঙ্গ খেত মজদুর সমিতি বনাম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মামলা, ১৯৯২) রয়েছে। তা-ও কেন এ ভাবে দুর্ঘটনার জেরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক রোগীকে তিনটি হাসপাতাল ভর্তি না করে ফিরিয়ে দেবে, সেই প্রশ্ন তুলে স্বাস্থ্য ভবনে অভিযোগ দায়ের করেছেন সুব্রতবাবুর ভায়রা নিরঞ্জন মিদ্যে। অভিযোগপত্রে ১৯৯২-র ওই মামলার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি।

Advertisement

গত ৪ জুলাই রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ সুভাষগ্রাম থেকে অটোয় চম্পাহাটি যাওয়ার পথে ম্যাটাডরের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা লাগে অটোর। মাথা ও ঘাড়ে প্রচণ্ড আঘাতে ছিটকে পড়েন সুব্রতবাবু। জ্ঞান ফিরতে দেখেন বারুইপুর হাসপাতালে রয়েছেন। গলার নীচ থেকে বাকি শরীরটা আর নাড়াতে পারছেন না। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, শিরদাঁড়ায় আঘাত লেগে এই অবস্থা। অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে তাঁকে নিয়ে এর পর শুরু হয় ভায়রাভাই নিরঞ্জন ও স্ত্রী আরতির ছোটাছুটি।

পরিবারের অভিযোগ, ৫ জুলাই বেলা ১১টায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা হাসপাতাল এমআর বাঙুরে ভর্তি করা হয় ওই প্রৌঢ়কে। সেখানে নিউরো সার্জারি বিভাগ নেই জানিয়ে চিকিৎসকেরা লিখিত ভাবে রোগীকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল বা বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজিতে (বিআইএন) নিয়ে যেতে বলেন।
রাত ৯টা নাগাদ সুব্রতবাবুকে ন্যাশনালে নিয়ে গেলে সেখানকার ডাক্তারবাবুরা জানিয়ে দেন, ওই হাসপাতালে ইমার্জেন্সি নিউরো সার্জারি চিকিৎসা হয় না। তাই বিআইএন-এ যেতে হবে।

এ বার বিআইএন। অভিযোগ, রাত ১১টায় তাঁকে ওই হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে পৌঁছলে চিকিৎসকেরা অ্যাম্বুল্যান্স থেকে রোগীকে নামাতেই দেননি। উল্টে রোগীর ঘাড়ে একটি কলার লাগিয়ে নিরঞ্জনবাবুদের থেকে ১ হাজার টাকা নেন তাঁরা। এবং হাসপাতালের টিকিটে কিছু ওষুধ লিখে ‘সিট নেই’ স্ট্যাম্প লাগিয়ে ফের ন্যাশনালে চলে যেতে বলেন। রোগী নিয়ে ভোর ৪টের সময়ে ফের ন্যাশনালের ইমার্জেন্সিতে গেলে সেখানকার চিকিৎসকেরা চরম দুর্ব্যবহার করে তাঁদের তাড়িয়ে দেন বলে অভিযোগ। এর পরে গত ৮ জুলাই রোগীকে নিয়ে ন্যাশনালের নিউরো সার্জারি আউটডোরে যান বাড়ির লোক। অভিযোগ, সে দিনও তাঁকে ভর্তি নেওয়া হয়নি। চিকিৎসকেরা আউটডোর টিকিটে একগুচ্ছ ব্র্যান্ডেড ওষুধ লিখে রোগীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

বিআইএনের অধিকর্তার পদে রয়েছেন এসএসকেএমের অধিকর্তা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি শুনেই ফোন নামিয়ে রাখেন। ন্যাশনাল মেডিক্যালের অধ্যক্ষা মঞ্জুশ্রী রায় অবশ্য জানিয়েছেন, তিনি তদন্ত করছেন।

অভিযোগ পাওয়ার পরে রাজ্যের স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, আলাদা ভাবে তদন্ত শুরু করেছেন তিনিও। কিন্তু ওই রোগীকে ভর্তির কী ব্যবস্থা করা হচ্ছে? সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘অবিলম্বে ওঁকে বিআইএন-এ আসতে বলেছি বাড়ির লোককে। সেখানে ভর্তি করে প্রয়োজনীয় সব রকম চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement