দীপেশ চক্রবর্তী, সন্মাত্রানন্দ এবং নলিনী বেরা। —ফাইল চিত্র।
হাজার বছর আগের অতীত ফুঁড়ে এসে মুণ্ডিতমস্তক এক বাঙালি বৌদ্ধ শ্রমণ এ বার আনন্দ পুরস্কারের অন্যতম চরিত্র। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশ!
আর এক চরিত্র আরও আগের। প্রায় লক্ষ বছরের পুরনো। টেথিস সাগর থেকে অভ্রংলিহ হিমালয়ের জন্ম হয়নি তখনও। সেই চরিত্র, এক ছোট্ট নদী। নাম সুবর্ণরেখা।
আর এক চরিত্র, সে-ও বহতা নদীর মতোই আমাদের সঙ্গে চলতে থাকে, অতীতের কথা বলতে বলতেই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা ধরতাই দেয় সে। তার নাম ইতিহাস!
২০১৭ আর ২০১৮, গত দু’টি বছরে প্রকাশিত বাংলা বইয়ের সম্ভার থেকে উঠে আসা এই তিন চরিত্রকে নিয়েই ১৪২৫ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কারের মায়ামৃদঙ্গ। লেখককে ছাপিয়ে বরাবরই যে-পুরস্কার সম্মানিত করতে চেয়েছে তাঁর সৃষ্টিকে।
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশকে নিয়ে বইটির নাম ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ (ধানসিড়ি)। ত্রিপুরার বাসিন্দা সন্মাত্রানন্দের লেখা প্রথম উপন্যাস, প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকসমাজে আলোড়ন ফেলেছিল।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
আলোড়ন বা হুল্লোড় কোনওটাই বড় কথা নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আত্মপ্রকাশ’ থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘ঘুণপোকা’, অনেকেই প্রথম আবির্ভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। কিন্তু কলকাতার নগরকীর্তনের বাইরে ত্রিপুরায় বসে বাংলা উপন্যাস লেখা! একদা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে বনফুল, সতীনাথ ভাদুড়ী অনেক দিকপালই বাংলার বাইরে থেকে সাহিত্য-সরস্বতীর আরাধনা করতেন। নতুন আনন্দ-তালিকায় যেন সেই ভুলে-যাওয়া ঐতিহ্য!
সন্মাত্রানন্দের উপন্যাসে বাংলাদেশের বজ্রযোগিনী গ্রাম থেকে বিক্রমশীলা, নালন্দা, তিব্বতের থোলিং মহাবিহার থেকে আজকের গড়িয়াহাট, সব জাদুবাস্তবতায় একাকার। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ তো সত্যিই অস্তিত্বহীন। নেই। তারা থাকে শুধু মানুষের সময়চেতনায়।
সময়চেতনা কোথায় নেই? সুবর্ণরেখা নদীর ধারে ছোট্ট গ্রাম। ছোট্ট নলিন এগিয়ে চলে ডিঙির মাঝি হংসী নাউড়িয়ার সঙ্গে। কাঁকড়ো-কুঁদরি-ভেলা-ভুডরুর জঙ্গল পেরিয়ে পথ, নদীতে মাঝিরা গাঁতি জাল বিছিয়ে রাখে। বর্ষায় সোঁতার জলে খলবলিয়ে ওঠে চ্যাঙ-গড়ুই-তুড়-মাগুর মাছ। আর গোবরগাদার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে ‘শালুইপোকা’। মা-কাকিমারা সেগুলি বালির খোলায় ভেজে খেতে দেন, নলিনের ঠাকুরমা ফোকলা দাঁতে হেসে জিজ্ঞেস করেন, ‘আর নাই বড় বউমা?’ ভূমিজ, সাঁওতাল, মাহাতোরা দল বেঁধে কোদাল-গাঁইতি কাঁধে চলে রিলিফ বাঁধের কাজে। শেষ বিকেলে ভাঙা বাতার ঘরে হুড়হুড় করে ঢুকে পড়ে ঘূর্ণি হাওয়ার ‘বিড়োল বাঁও।’ এগিয়ে চলে নলিনী বেরার উপন্যাস ‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ (দে’জ)।
আজ থেকে দুই দশক আগেও বাঙালি হয়তো নলিনীবাবুর এই কাহিনিকে ‘আঞ্চলিক উপন্যাস’ বলে দেগে দিত। হাল আমলে আমাদের বোধোদয় হয়েছে। সাহিত্যকে এই ভাবে ‘নাগরিক-আঞ্চলিক’ বা ‘কেন্দ্র-প্রান্ত’ বিভাজনে আর ভাঙা যায় না। অখ্যাত তাৎমাটুলি থেকে ঢোঁড়াইরা ছুটে আসতেই পারে সাহিত্যের পাক্কি
সড়কের দিকে, মাকোন্দো গ্রামের মরুভূমিতেও জো বুয়েন্দিয়া দেখে ফেলতে পারে বালিতে নিমজ্জিত অর্ণবপোত। নলিনী বেরার এই উপন্যাসকে বাছাই তালিকায় রেখে আনন্দ পুরস্কার নতুন সাহিত্যচেতনাকেই কুর্নিশ জানাচ্ছে।
তিন লেখকের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ দীপেশ চক্রবর্তী। তালিকায় রয়েছে তাঁর নতুন বই ‘মনোরথের ঠিকানা’ (অনুষ্টুপ)। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাংলার শ্রমিক, জনজীবনে ইতিহাসচেতনা থেকে পরিবেশ দূষণ, ইউরোপের আত্তীকরণ, কত কী নিয়েই যে ভেবেছেন! একদা সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ়-এ রণজিৎ গুহের সঙ্গী, আবার কখনও ‘কেন আমি সাবঅল্টার্ন নই।’ মাত্র ছ’বছর আগে বাংলায় প্রথম বই, এবং সেখানেই তৈরি করে দিয়েছিলেন বাংলা ভাষার নতুন শব্দবন্ধ: উত্তরসাক্ষর সমাজ। যে-সমাজে সবাই সাক্ষর, কিন্তু বই না পড়ে, সিনেমা-টিভিতে ইতিহাস দেখে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোর কলি শুরুর ঢের আগেই বিপদঘন্টি শুনিয়েছিলেন ইতিহাসবিদ।
নতুন বইয়ে তাঁর স্পষ্ট ঘোষণা, ‘আমাদের ইতিহাসের সব পলিটিকাল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এটা মেনে নিয়ে যে, অর্থনৈতিক অবস্থা যা-ই হোক, আমরা সর্বশেষতম অধিকার চাইব মানুষের জন্য।’ মোদী-অমিত শাহের ভারত এই কথা শুনবে কি না, পরের প্রশ্ন। কিন্তু বাঙালির আনন্দ পুরস্কারের বাছাই তালিকায় মনোরথ রয়ে গেল!
এই তিনের মধ্য থেকেই চূড়ান্ত পর্বে বিচারকেরা সম্মান জানাবেন একটি বইকে। কোনটি ১৪২৫ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কারের জ্যোতির্বলয়ে উঠে আসে, আপাতত তারই প্রতীক্ষা।