দ্বিতীয় ইনিংসেও জনমুখীতে জোর নবান্নের

প্রথম ইনিংস যেখানে শেষ করেছিলেন, নবান্নে পা রেখে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করলেন সেখান থেকেই। শুক্রবার টাউন হলে নতুন সরকারের প্রথম প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার্তা দিলেন, এ বারেও তাঁর অগ্রাধিকার-তালিকায় থাকবে পানীয় জল, রাস্তা তৈরি, দু’টাকার চাল, কন্যাশ্রী, যুবশ্রীর মতো জনমুখী প্রকল্পগুলি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৬ ০৪:২০
Share:

নতুন সরকারের প্রথম প্রশাসনিক বৈঠকের আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সংবর্ধনা কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের। শুক্রবার টাউন হলে সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি।

প্রথম ইনিংস যেখানে শেষ করেছিলেন, নবান্নে পা রেখে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করলেন সেখান থেকেই। শুক্রবার টাউন হলে নতুন সরকারের প্রথম প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার্তা দিলেন, এ বারেও তাঁর অগ্রাধিকার-তালিকায় থাকবে পানীয় জল, রাস্তা তৈরি, দু’টাকার চাল, কন্যাশ্রী, যুবশ্রীর মতো জনমুখী প্রকল্পগুলি।

Advertisement

বৈঠক শেষে একাধিক মন্ত্রী ও আমলার পর্যবেক্ষণ, ওই সব জনপ্রিয় প্রকল্পের সাফল্যে ভরসা করেই শাসকদল বিধানসভা ভোটে গিয়েছিল। আর নির্বাচনী ফলাফল দেখিয়ে দিয়েছে, গ্রাম-শহরের মানুষ মমতাকে ফেরায়নি। বরং দু’হাত উপুড় করে ভোট ফেলেছে ঘাস-ফুলের বাক্সে। ‘‘অতএব মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী ওঁর দ্বিতীয় সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিতেও ওই প্রকল্পগুলোকে সামনে রাখার তাগিদ বোধ করবেন, এটা স্বাভাবিক।’’— মন্তব্য করেছেন একাধিক আমলা।

তবে গুরুত্ব শুধু অগ্রাধিকারের প্রকল্পে নয়। মুখ্যমন্ত্রীর সাফ কথা— সব দফতরকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে যাবতীয় কাজ করতে হবে। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ— ছোট বড় বিচার না-করে সরকারকে যে সবই করতে হবে, সে বার্তা দিয়ে মমতা বলেন, ‘‘আমাদের সব কিছু ভাবতে হয়। লঙ্কা চাষ থেকে ইনস্টিটিউশনাল ডেলিভারি— সবই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’’

Advertisement

জেলায় জেলায় কাজের খতিয়ান নিতে মমতার প্রথম সরকার সাড়ে চার বছরে ১২১টি প্রশাসনিক বৈঠক করেছিল। এর বেশ ক’টা হয়েছিল টাউন হলে। এ দিন সেখানেই ১২২তম (নতুন সরকারের প্রথম) প্রশাসনিক বৈঠকটির আয়োজন হয়। যার সূচনায় সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘নির্বাচনের জন্য গত ন’মাস কোনও কাজ হয়নি।

২০১৬-র ২৯ জানুয়ারি শেষ এমন বৈঠক হয়েছিল। তাই যেখানে আমরা শেষ করেছিলাম, সেখান থেকে এ বার শুরু করা চাই।’’

এমতাবস্থায় বছরের গোড়ায় তাঁর সরকারের বানিয়ে দেওয়া প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার ধরেই আমলাদের নতুন ভাবে কাজে নামার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং ইঙ্গিত দিয়েছেন, ‘কর্মযজ্ঞে’ তাঁর নিজের কর্মসূচিও আগাম ছকা হয়ে গিয়েছে। যেমন, জঙ্গলমহল দিয়ে তিনি শুরু করতে চলেছেন জেলা সফর। ‘‘আগামী ১৪ জুন আমি জঙ্গলমহলে যাব।’’— ঘোষণা মমতার।

সরকারের ‘সাফল্য’ বর্ণনা করতে গিয়ে এ দিনের বৈঠকে মমতা তাঁর আধিকারিকদের জানান, গত অর্থবর্ষে (২০১৫-১৬) রাজ্যের পরিকল্পনা খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৪৯ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। কিন্তু সেই সীমা ডিঙিয়ে ৫৩ হাজার ১০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে! মানে, বাড়তি চার হাজার কোটি। মমতার দাবি— গত কুড়ি বছরে পশ্চিমবঙ্গে এ ভাবে পরিকল্পনা খাতের বরাদ্দ ছাপিয়ে কাজ হয়নি। ‘‘অনেক রাজ্যে পরিকল্পনা বরাদ্দই পুরো খরচ হয় না। এখানে বেশি হয়েছে। তাই গ্রোথ রেটও এখানে অনেক বেশি।’’— অভিমত মুখ্যমন্ত্রীর। অর্থ দফতরের হিসেব বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে রাজ্যে পরিকল্পনা খাতে ৩৯ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ ছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে তার ৩৫% বেশি কাজ হয়েছে।

পরে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘নতুন করে নতুন সরকারের কাজ শুরু হল। আগের সরকারের পারফরম্যান্স রিভিউ করে আমরা ফের উন্নয়নে নামব। ভোটের জন্য মাঝ পথে বেশ কিছু কাজ আটকে ছিল। সেগুলো আবার চালু করতে হবে।’’ তিনি জানিয়েছেন, চলতি অর্থবর্ষের জন্য অর্থ দফতর ইতিমধ্যে ১১ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা রিলিজ করেছে। মমতার দাবি: ২০১১-র তুলনায় এই ক’বছরে পরিকল্পনা খাতে রাজ্যের ব্যয় চার গুণ বেড়েছে। ২০১১-১২ অর্থবর্ষে খরচ হয়েছিল ১৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবর্ষে অঙ্কটা ৫৩ হাজার কোটির বেশি।

‘‘আজ একশো দিনের কাজে বাংলা মডেল। তবু আমাদের কাজ থামছে না। আগামী জুলাইয়ের মধ্যে আমরা রাজ্যের একশো শতাংশ ঘরে আলো পৌঁছে দেব।’’— বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

মুখ্যমন্ত্রী এ দিন কিছু দফতরকে নির্দিষ্ট কিছু নির্দেশও দিয়েছেন। যেমন, পরিবহণ দফতরকে বলেছেন রাজ্যের সমস্ত ঘাটের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার নিতে। সিদ্ধান্তটির নেপথ্যে শান্তিপুরে সাম্প্রতিক নৌকাডুবি-কাণ্ডের ছায়া দেখছেন অফিসারদের একাংশ। বিভিন্ন পরিবহণ নিগমের ডিপোর অতিরিক্ত জমি বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারে দ্রুত উদ্যোগী হতে বলেছেন কর্তাদের। পাশাপাশি খাদ্য দফতরকে বলেছেন ডুপ্লিকেট রেশন কার্ড বাতিল করার ব্যাপারে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা নিতে।

বিরোধীরা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম প্রশাসনিক বৈঠকের কড়া সমালোচনায় মুখর। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ তুলে বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের প্রতিক্রিয়া, ‘‘ভোট পরবর্তী হিংসা প্রতিরোধ সম্পর্কে বৈঠকে কোনও কথা হয়নি। মূল্যবৃদ্ধি রোধ বা সরকারি কাজের দায়বদ্ধতা নিয়েও উচ্চবাচ্য নেই!’’ মান্নান জানিয়েছেন, আক্রান্তদের তালিকা নিয়ে শিগগিরই তাঁরা বাম পরিষদীয় দলের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাবেন।

পাশাপাশি বাম পরিষদীয় দলের নেতা সুজন চক্রবর্তীও মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে কোনও শান্তি-বার্তা দেখতে পাচ্ছেন না। ‘‘বাম আমলেও রমজান বা অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবের সময়ে রেশনে অতিরিক্ত খাদ্য দেওয়া হতো। এখন সবই এমন ভাবে করা হচ্ছে, যেন মমতাই প্রথম করছেন! এর জন্য প্রশাসনিক বৈঠকের কী দরকার?’’— কটাক্ষ সুজনবাবুর। কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার মন্তব্য, ‘‘জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জেলায় প্রশাসনিক বৈঠকে গেলে বিরোধী বিধায়কদের সঙ্গে দেখা করতেন। মমতা পাঁচ বছরে এক বারও করেননি। আশা করব, এ বার করবেন।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement