লর্ড ক্যানিংয়ের বাড়ি বাঁচানোর উদ্যোগ

ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিঙ্গাপুর বন্দরকে টেক্কা দিতে মাতলা নদীর তীরে ‘আধুনিক বন্দর’ তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন লর্ড ক্যানিং। ‘লাটসাহেবের’ নির্দেশে সেই কাজ অনেকটাই এগিয়েছিল। জঙ্গল কেটে তৈরি হল নয়া কোম্পানির সদর দফতর, জনপদ।

Advertisement

অশোক সেনগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৩১
Share:

লর্ড ক্যানিংয়ের ভাঙাচোরা সেই বাড়ি।

ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিঙ্গাপুর বন্দরকে টেক্কা দিতে মাতলা নদীর তীরে ‘আধুনিক বন্দর’ তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন লর্ড ক্যানিং। ‘লাটসাহেবের’ নির্দেশে সেই কাজ অনেকটাই এগিয়েছিল। জঙ্গল কেটে তৈরি হল নয়া কোম্পানির সদর দফতর, জনপদ। ইতিহাসের অধ্যায়ের টিঁকে থাকা স্মৃতি-বিজড়িত একমাত্র ভবনটি সংরক্ষণে উদ্যোগী হল রাজ্য সরকার। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের পদস্থ একদল অফিসার ঘটনাস্থলে যান।

Advertisement

১৮৫৬ থেকে ১৮৬২এই সময় কালের প্রথম দু’বছর ভারতের গভর্নর জেনারেল এবং পরের চার বছর ভাইসরয় ছিলেন চার্লস যোহান আর্ল (লর্ড) ক্যানিং। তৈরি হয় ‘পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি’। তারা মাতলা নদীর ধারে তৈরি করায় স্ট্র্যান্ড, হোটেল, কিছু বাড়ি। কিন্তু ১৮৬৭ সাল নাগাদ নদীর পথ পরিবর্তনে সে সব ভেঙে যায়। ইতিমধ্যে ১৮৬২-তে শিয়ালদহ দক্ষিণ (তত্‌কালীন বেলেঘাটা স্টেশন) থেকে ক্যানিং পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন করে ইস্ট বেঙ্গল কোম্পানি। ১৮৮৭-তে ইস্ট বেঙ্গল কোম্পানি রাষ্ট্রায়ত্ত হয়।

কী ভাবে বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্যনিংয়ের স্মৃতি? ক্যানিং ও সুন্দরবন নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন শিক্ষক ক্ষিতীশ বিশাল। তিনি জানান, “বাড়িটি ছিল ‘পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি’-র সদর দফতর। ১৮৭২-এ সংস্থা বন্ধ হয়ে যায়। নামমাত্র টাকায় ওই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় দু’তিনজন ওই বাড়ি ও সংলগ্ন জমি কিনে নেন।” সরকারি প্রতিনিধি হিসাবে সেই বাড়িটি দেখতে গিয়েছিলেন মহকুমা তথ্য অফিসার তাপস ভাওয়াল। তিনি বলেন, “বাড়িটি তৈরির সঠিক দিনক্ষণ জানা না থাকলেও নথি দেখে অনুমান করা যায়, পৌনে দু’শ বছর আগে এটি তৈরি করা হয়েছিল। এত আকর্ষণীয় স্থাপত্যের বাড়ি সংরক্ষণ করে একটা পর্যটনকেন্দ্র করা যেতে পারে।”

Advertisement

বেশ কিছুকাল আগে মৃণাল সেন বাড়িটি দেখে সেখানে শ্যুটিং করতে চান। ক্ষিতীশবাবু বলেন, বিশেষ কিছু কারণে সেখানে শ্যুটিং করা সম্ভব হয়নি। তবে, এটি ছিল লর্ড ক্যানিংয়ের নামাঙ্কিত সংস্থার সদর দফতর। তিনি এবং লেডি ক্যানিং ওখানে গেলে যে বাড়িটিতে থাকতেন, সেটির অস্তিত্বের বেশির ভাগটাই লোপ পেয়েছে।

সংরক্ষণের অভাবে ব্যবহার-অযোগ্য ঘর।

ক্যানিংয়ের এই বাসভবন ক্যানিং স্টেশন থেকে মিনিট পনেরো হাঁটাপথ। প্রাচীন ভবনটির অবস্থা খুবই জীর্ণ। লোহার মূল ফটকটি বহুকাল আগেই উধাও হয়ে গিয়েছে। পুরু দেওয়ালের বিভিন্ন অংশে ফাটল। বাড়ির তিন দিকে বিভিন্ন জায়গায় বটবৃক্ষ বাড়িয়ে চলেছে এই ফাটলের মাত্রা। উঁচু স্তম্ভগুলোর ইট খসে পড়ছে। বাড়ির দু’টি তল মিলিয়ে অন্তত পনেরোটি ঘর। কড়িকাঠের ছাদের উচ্চতা অন্তত ১৫ ফুট। ভূগর্ভেও একটি তল আছে। একসময়ে সেটি ব্যবহৃত হত। বহুকাল ব্যবহৃত হয় না। বন্ধ করে রাখা হয়েছে একতলার বেশির ভাগ অংশ।

বাড়ির দ্বিতলে ঘোষ পরিবার। এই পরিবারের দুই ভাইয়ের ছোটজন বুরন ঘোষের স্ত্রীর দাবি, “আমার শ্বশুরমশাই কোম্পানির লোকেদের কাছ থেকে বাড়িটি কিনেছিলেন। জেলাশাসক ও তাঁর লোকজন এসে দেখে গিয়েছেন বাড়িটি। আমরা বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য হস্তান্তরে সায় দিয়েছি।”

ঘোষ পরিবারের এ দাবি সম্পর্কে অবশ্য সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে জেলা প্রশাসনের তরফে। এক পদস্থ অফিসার বলেন, “পূবে মাতলা নদী, পশ্চিমে ক্যানিং হাসপাতাল প্রায় সাড়ে সাতশ একর জমি ‘পোর্ট ক্যানিং কোম্পানিকে’ সরকার ইজারা দেয়। খাতায় এই কিছুকাল আগেও গোটা অংশটি ছিল একটি বিশেষ (১০৪২) খতিয়ানে।” তাঁর দাবি, শুধু ওই বাড়ি নয়, গোটা অঞ্চলে পরবর্তী নানা সময়ে তৈরি বিভিন্ন বাড়ির আইনি মালিকানা নিয়ে ধন্দ ও সংশয় রয়েছে। সে সব নিয়মিতকরণের কথা ভাবা হচ্ছে।

এলাকার জমি চরিত্র গোলমেলে বলে স্বীকার করেন ব্লক সভাপতি তথা জেলা পরিষদের সহ-সভাপতি শৈবাল লাহিড়ি। তিনি বলেন, “ওই অঞ্চলের জমির পুনর্বিন্যাস ও ক্যানিংয়ের বাড়ি সংরক্ষণের ব্যাপারে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে দরবার করা হয়েছে প্রশাসনের কাছে।” তাঁর অভিযোগ, ওই অঞ্চলের অর্থাত্‌ খাসমহল বলে চিহ্নিত এলাকা জমিগুলো সরকারের অথচ চরিত্র বদল না করলে সরকার কর-বাবদ আয় করতে পারছে না।

আজন্ম, মানে গত প্রায় ছয় দশক শৈবালবাবু বাড়িটিকে কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁর দাবি, “ক্যানিংয়ের আরও একটি ঐতিহ্যসম্পন্ন বাড়ি ছিল অদূরেই। অযত্ন-অবহেলায় দীর্ঘকাল পড়ে থাকায় সেটি ভেঙে যায়। যাঁরা সেটির মালিক বলে দাবি করতেন, তাঁরা সেই জমি বিক্রি করে দিয়েছেন।” সেখানে গিয়ে দেখা গেল বেশ কিছু ঘরবাড়ি। আবাসিকরা কেউ ক্যানিংয়ের স্মৃতির কথা জানাতে পারলেন না। ক্যানিংয়ের ব্যবহৃত বেশ কিছু সামগ্রিও ঘোষ-পরিবারের সচেতনতার অভাবে নষ্ট হয়েছে বলে দাবি শৈবালবাবুর।

সরকারি নথিতে ক্যানিংয়ের বাড়ি এবং সংলগ্ন জমি ‘খাসমহল’ হিসাবে চিহ্নিত ছিল। তাই ওই তল্লাটের জমি-বাড়ি কেনাবেচার আইনি ফাঁক ছিল। ভূমি সংস্কারের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলাশাসক সোমনাথ দে এ কথা জানিয়ে বলেন, “সম্প্রতি প্রথা মেনে এ জমি বিশেষ তালিকা থেকে সাধারণ জমির তালিকায় আনা হয়েছে।” তবে ক্যানিংয়ের বাড়িটি কবে, কারা, কী ভাবে সংরক্ষণ করবে তা বিবেচনাধীন। এই ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। জেলাশাসকের পরিদর্শক দলে ছিলেন সোমনাথবাবু। জমির চরিত্র বদল করে বাড়তি আয়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান সোমনাথবাবু।

—নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement