অঙ্কন: নির্মাল্য প্রামাণিক।
কারও জন্য বরাদ্দ চড়-থাপ্পড়, কাউকে আচমকা মারা হচ্ছে ঘুষি। কারও আবার নাক-মুখ ফাটছে রডের ঘা খেয়ে।
কারা মারছে, স্পষ্ট নয়, কেন মারছে— তা নিয়েও পুলিশ অন্ধকারে। কিন্তু ঘটনা হল, ভোটের বাজারে যখন কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ গোটা রাজ্য, তখন এমন উটকো হামলার শিকার হচ্ছেন হাবরার বাউগাছি, সলুয়া, নাংলা, রাজবল্লভপুর, ফুলতলা, শিমূলপুরের মতো কয়েকটি গ্রামের মানুষ। হামলা চলছে স্কুটি, বাইক থেকে। লাল রঙের একটি স্কুটি তো এখন রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের কাছে। পাশ দিয়ে বাইক, স্কুটি গেলে ভয়ে কাঁপছেন অনেকে। কেউ কেউ তো আঁধার ঘনালে বাড়ির বাইরেই পা রাখছেন না। পড়ুয়াদের অনেকেরই সন্ধের পরে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে যাওয়া বন্ধ। বৃদ্ধদের সান্ধ্য আড্ডায় দাঁড়ি পড়েছে।
কেউ কেউ আবার প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা ভাবছেন। বাইক, স্কুটি দেখলে তাড়া করে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গত পনেরো দিন ধরে চলছে এই পরিস্থিতি। বিদায়ী বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও ঘটনায় উদ্বিগ্ন। তিনি জানিয়েছেন, পুলিশকে বলা হয়েছে, দ্রুত দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করতে।
পুলিশ অবশ্য বৃহস্পতিবার রাতেই গ্রেফতার করেছে সন্দেহভাজন চারজনকে। করেছে।পুলিশ জানিয়েছে ধৃতদের নাম মিঠুন মণ্ডল, দেবাশিস মজুমদার, দেবব্রত রায় এবং সলিল সরকার। বাড়ি হাবরার কাশীপুর, পাঁচঘড়িয়ায়। পুলিশের দাবি, এই যুবকদের সঙ্গে আছে আরও চারজন। এই টিমই অপারেশন চালাচ্ছে। কিন্তু কেন? এখনও পর্যন্ত সদুত্তর নেই পুলিশের কাছে। কোনও মানসিক সমস্যার জন্য নাকি নেশাসক্ত অবস্থায় বে-ফালতু হামলা চালানো হচ্ছে কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। হামলার কারণ উদ্ধার না হওয়ায় বাসিন্দাদের একাংশ আবার এই গ্রেফতারি নিয়েও সংশয়ে। পুলিশ সঠিক দুষ্কৃতীদেরই পাকড়াও করেছে তো, উঠছে সেই প্রশ্ন। পুলিশ কর্তাদের অবশ্য দাবি, তদন্ত ঠিক পথেই এগোচ্ছে।
শুক্রবার এলাকায় গিয়ে জানা গেল আতঙ্কের নানা উপাখ্যান।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী বৈশাখী পাল গত রবিবার সন্ধ্যায় বাড়ির কাছেই গিয়েছিল মুদিখানা দোকানে। মালপত্র কিনে বাড়ি ফেরার পথে উল্টো দিক থেকে একটি স্কুটি আসতে দেখে। এমন তো সর্বক্ষণই হচ্ছে। আমল না দিয়ে রাস্তার একটু পাশে সরে যায় মেয়েটি। কিন্তু আচমকাই ওই স্কুটিতে বসে থাকা তিন যুবকের মধ্যে একজন ভারী কিছু দিয়ে মাথায় মারে। পড়ে যায় বৈশাখী। তার চিৎকার শুনে ছুটে আসেন আশপাশের মানুষ। কিন্তু ‘বীরপুঙ্গব’রা ততক্ষণে পিঠটান দিয়েছে।
ডান চোখে আঘাত লেগেছে মেয়েটির। হাবরা, বারাসত হাসপাতাল হয়ে আপাতত আরজিকর হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে বৈশাখীর। বাবা সুকুমার পালের দুই ছেলে মেয়ের মধ্যে বৈশাখীই বড়। সুকুমারবাবুর সামান্য আয়ে সংসার চলে। শুক্রবার বাউগাছি মণ্ডলপাড়ায় নিজের বাড়িতে বসে বললেন, ‘‘মেয়েটা ডান চোখে দেখতেই পাচ্ছে না। আমাদের কাউকে চিনতে পারছে না। চোখ এখনও ঘোলাটে হয়ে আছে। চিকিৎসকেরা দৃষ্টিশক্তি নিয়ে আশার কথা শোনাতে পারেননি।’’ অভাবের সংসারে মেয়ের চিকিৎসার খরচ কী ভাবে চালাবেন, ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না সুকুমার।
কথা হচ্ছিল বাউগাছি গ্রামের বৃদ্ধ জাহাঙ্গির মণ্ডলের সঙ্গে। বললেন, ‘‘ভয়ে আমরা কেউ সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাইরে বের হচ্ছি না। সন্ধ্যায় একটু বাজারে যেতে চাইলে বৌমারা নিষেধ করছেন।’’ ওই এলাকারই বাসিন্দা দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সুফল ঘোষ জানায়, সন্ধ্যায় আর পড়তে বেরোচ্ছে না। বাড়ির বড়রা বারণ করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, দুষ্কৃতীরা ঢুকছে মূলত হাবরা শহরের জয়গাছি থেকে। হাবরা-মছলন্দপুর বাইপাস রাস্তা ধরেই তারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পাকা পিচের রাস্তায় পাশে বিদ্যুতের খুঁটি থাকলেও অনেক জায়গায় তাতে আলো নেই। অনেক জায়গায় আবার রাস্তার দু’পাশে বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ। সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে তাদের হুজ্জুত। স্কুটি বা বাইকে থাকছে তিনজন শক্তপোক্ত চেহারার যুবক। তাদের হাতে লাঠি, রড়। কোনও কারণ ছাড়াই তারা পথচারীদের আঘাত করছে। তারপরে ওই রাস্তা ধরেই ফের হাবরা শহরের দিকে বা বসিরহাটের দিকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
বাউগাছি গ্রামের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সুমন সরকার ওই বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হয়ে নাকের হাড় ভেঙেছে। গত শনিবার সন্ধ্যায় সে মছলন্দপুর গিয়েছিল ভায়ের জন্য ব্যাগ কিনতে। ঘড়িতে তখন রাত সওয়া ৮টা হবে। সাইকেলে করে একাই ফিরছিল সুমন। এমন সময়ে স্কুটি করে এসে তাকে লক্ষ্য করে সামনে থেকে রড দিয়ে মুখে মারে একজন। রক্তে ভেসে যায় শরীর। সুমনের কথায়, ‘‘মাথায় লাগলে হয় তো মরেই যেতাম। চিকিৎসেকরা বলেছেন, নাকের হাড় ভেঙেছে। অস্ত্রোপচার করতে হবে। প্রায় ৩ হাজার টাকা ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গিয়েছে।’’ এমন অভিজ্ঞতা আরও অনেকের। বল্লভপুরের বাসিন্দা আবুবক্কর মণ্ডল বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। মছলন্দপুরে একটি ওষুধের দোকানে কাজ করেন। সন্ধ্যায় সাইকেলে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে অন্ধকার থাকায় মোবাইল জ্বালিয়ে আসছিলেন। সে সময়ে স্কুটিতে করে দুষ্কৃতীরা এসে তাঁর মোবাইলটি কেড়ে নিয়ে গিয়েছে।
সলুয়ার বাসিন্দা কলেজ ছাত্রী সুলতানা খাতুন ২৯ এপ্রিল রাত পৌনে ৮টার সময়ে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে সাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন। বইয়ের ব্যাগ ছিল সাইকেলের সামনে বাস্কেটে। স্কুটি করে দুষ্কৃতীরা এসে সেই ব্যাগ তুলে নিয়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা সাবির আলি বিশ্বাস জানান, মোটরবাইক, গাড়ি নিয়ে তাঁরা প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজেছিলেন। কিন্তু হামলাকারীদের সন্ধান মেলেনি। পর দিন ভোরে বইয়ের ব্যাগটি পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে ১৭০ টাকা ছিল, সেটা উধাও।
রাজবল্লভপুর এলাকার বাসিন্দা নাজির হোসেন জানালেন, এমন আতঙ্ক তৈরি হয়েছে যে বাইক, স্কুটির আওয়াজ পেলেই মানুষ রাস্তা থেকে সরে যাচ্ছেন। ছুটে পালাচ্ছেন। স্থানীয় কয়েকজন প্রবীণ মানুষের আশঙ্কা, জনরোষ এতটাই বেড়েছে, যুবকেরা ধরা পড়লে কী হবে বলা মুশকিল!
পুলিশ প্রথম দিকে গুরুত্ব দিতে চায়নি বলেও অভিযোগ। তবে এখন বিষয়টা তাদেরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চারজনকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চালানোর পাশাপাশি এলাকায় সন্ধ্যার পরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। রাত পর্যন্ত চলছে পুলিশি টহল। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাইক দাঁড় করিয়ে তল্লাশি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী, র্যাফ টহল দিচ্ছে।