কপিল মুনির মন্দির সংস্কারের কাজ চলছে।
কপিলমুনির মন্দিরের দৌলতে তীর্থস্থান হিসেবে রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা ভারতে নাম ছড়িয়ে পড়েছে সাগরদ্বীপের। প্রত্যেক বছর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি মকর সংক্রান্তির দিনে সাগরে অনুষ্ঠিত হয় এ রাজ্যের সব থেকে বড় মেলা। তা সত্ত্বেও আজও মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন রয়ে গিয়েছে সুন্দরবনের বৃহত্তম দ্বীপ, সাগরদ্বীপ।
স্থানীয় মানুষ, পর্যটক বা তীর্থযাত্রীদের গঙ্গাসাগরে পৌঁছতে যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সে জন্য গড়ে উঠেছে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। তার ফলে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের নবকুমারের মতো কোনও নবাগতকে পথ ভুলে ভয়ঙ্কর কাপালিকের হাতে গিয়ে পড়ার ঘটনা আজ নিতান্তই গল্পকথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, যাতায়াতের সমস্যা এড়াতে ও সাগরে পর্যটন শিল্পের উন্নতির জন্য রেলপথ দিয়ে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হোক সাগরদ্বীপকে।
কথিত আছে, অযোধ্যার ঈক্ষাকু বংশের রাজা সগরের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া চুরি করে পাতালপুরী অর্থাত্ গঙ্গাসাগরে কপিল মুনি আশ্রমের পেছনে লুকিয়ে রেখেছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। সেই ঘোড়া খুঁজতে গিয়ে ধ্যান ভাঙানোর অপরাধে কপিল মুনির রোষানলে পড়ে ভস্মীভূত হয়েছিলেন সগর রাজের ষাট হাজার পুত্রসন্তান। তাঁদের উদ্ধার করতে সগরের পৌত্র ভগীরথ কপিল মুনির নির্দেশ মতো স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে আসেন। গঙ্গা এসে সাগরে মিলিত হন এবং গঙ্গা স্পর্শে রাজা সগরের পুত্রেরা জীবন ফিরে পান। সেই কারণেই, প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে গঙ্গা ও বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থলে অবস্থিত গঙ্গাসাগর তথা সাগরদ্বীপ তীর্থস্থান হিসেবেই খ্যাতি লাভ করেছে। পুরাণ মতে, মকর সংক্রান্তির দিনই গঙ্গাসাগরে সগরপুত্রদের শাপমুক্তি ঘটেছিল, পুনর্জন্ম লাভ করেছিলেন তাঁরা। তাই প্রতি বছর মকর সংক্রান্তির দিন ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ হাজির হন স্নান সেরে পুণ্যার্জনের আশায়। মেলার ক’দিনে প্রচুর জনসমাগমে গমগম করে গঙ্গাসাগর।
মুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে গঙ্গাসাগরে পৌঁছতে গেলে লট ৮ ঘাট থেকে ভেসেলে চেপে কচুবেড়িয়া ও সেখান থেকে বাস, মিনিবাস বা ট্রেকার ধরে গঙ্গাসাগর যাওয়া যায়। কিন্তু নদীর বুকে যেখানে সেখানে পলি জমে চর জেগে ওঠায় ভাটার সময়ে কার্যত বন্ধ হয়ে যায় ভেসেল সার্ভিস। তাই মেলার সময় যাতে যাতায়াতের কোনও অসুবিধা না হয় তার জন্য মেলার ক’দিন ৮ নম্বর ঘাট থেকে কচুবেড়িয়া পর্যন্ত নদীপথে ড্রেজার দিয়ে মাটি কেটে নদীর গভীরতা বাড়ানো হয়। নৌকায় বা কখনও চরের উপর বাঁশ পুঁতে কাঠামো বানিয়ে তার উপরে লালবাতি লাগানো হয়। সেই সঙ্গে, দিক নির্ণায়ক লাগিয়ে রুট মার্কিং করে দেওয়া হয়। সেই রুট দিয়ে মেলার দিনগুলি ভেসেল চলাচল করে। বছরের অন্য দিনগুলিতেও যাতে স্থানীয় মানুষ, পর্যটক বা তীর্থযাত্রীরা কোনও অসুবিধায় না পড়েন, সে জন্য জোয়ারের সময় অতিরিক্ত ভেসেল চালিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়।
এমনই ঝকঝকে মন্দির পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তা।—নিজস্ব চিত্র।
মেলার সময়ে কচুবেড়িয়া ঘাটের উপর যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ কমানোর জন্য নামখানা থেকে চেমাগুড়ি হয়ে গঙ্গাসাগরে যাওয়ার জন্য একটি বিকল্প পথ খোলা হয়। কিন্তু গঙ্গাসাগর মেলার দিনগুলি ছাড়া অন্যান্য দিন সেই সার্ভিস বন্ধ থাকে। সম্প্রতি সরকারি প্রচেষ্টায় নামখানা থেকে জলপথে বেণুবন হয়ে সড়ক পথে চেমাগুড়ি পর্যন্ত যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু পথে যাতায়াত জোয়ারভাটার উপরে নির্ভরশীল। যে কারণে নিত্য প্রয়োজনে এই পথ ব্যবহার করতে ভরসা করেন না মানুষ। এই রুটের প্রচারও তেমন হয়নি। এ ছাড়াও, নামখানা থেকে সাগরের যাওয়ার জন্য নৌকা রয়েছে। কিন্তু কোনটাই স্থায়ী সার্ভিস না হওয়ায় নদী পেরোতে গেলে ভরসা করতে হয় সেই কচুবেড়িয়া-লট ৮ ঘাটের ভেসেল সার্ভিসের উপরে।
তবে আগের থেকে যাতায়াত অনেক সহজ হয়েছে। দিন কয়েক আগে পুরুলিয়া থেকে সপরিবারে গঙ্গাসাগরে এসেছিলেন পেশায় ব্যবসায়ী সঞ্জীব সাহা। জানালেন, ছেলেবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে একবার সাগরে এসেছিলেন। কিন্তু তখন যোগাযোগ বা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। তাই এ বারেও একরাত গঙ্গাসাগরে থেকেই ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু গঙ্গাসাগরে পা রেখে কিছুতেই ছোটবেলার স্মৃতির সঙ্গে বর্তমানকে মেলাতে পারছেন না। তিনি জানান, ছেলেমেয়েদের আবদার মেনে দু’রাত কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
জল পথের সমস্যা যদিও বা পর্যটক, তীর্থযাত্রীদের সমস্যায় ফেলে স্থলপথে কচুবেড়িয়া থেকে গঙ্গাসাগরের যাওয়ার চিত্রটা কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো। মাত্র ৩০ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দেওয়ার জন্য রয়েছে প্রচুর যানবাহন। বাস, মিনিবাস, লাক্সারি বাসের পাশাপাশি রয়েছে ছোট ছোট ম্যাজিক বা প্রাইভেট গাড়ি। প্রত্যেক পনেরো মিনিট অন্তর অন্তর মিলছে বাস মিনিবাস সার্ভিস। আর তুলনায় ভাড়া একটু বেশি হলেও গঙ্গাসাগরের নানা দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরে দেখার জন্য ছোট গাড়িগুলির কোনও জুড়ি নেই। যা বছর কয়েক আগে কল্পনাই করা যেত না। রয়েছে প্রিপ্রেড ট্যাক্সির সুবিধাও। আর গঙ্গাসাগর মেলার জন্য প্রতি বছরই রাস্তা সারাই হওয়ার সুবাদে কচুবেড়িয়া-গঙ্গাসাগর রুটের রাস্তার মান যে কোনও রাজ্য সড়ককে লজ্জায় ফেলবে।
শুধু সড়কপথ নয়, নদী পথেও যাতায়াতের যাতে উন্নতি ঘটে সে জন্য প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ভেবে দেখার আবেদন জানান বাসিন্দারা। রঞ্জিত দাস, রতন সাউ, সুশান্ত দাস, মনোরঞ্জন মণ্ডল, প্রশান্ত গিরিরা আবার এক ধাপ এগিয়ে বলেন, “ভেসেল নয় চাই ট্রেন।” তাঁদের দাবি, মুড়িগঙ্গা নদীর উপরে যে ভাবে থাম বানিয়ে সাগরে বিদ্যুত্ নিয়ে যাওয়া হয়েছে, একই ভাবে নদীর উপর দিয়ে রেলপথ নিয়ে গিয়ে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হোক সাগরদ্বীপ। স্টেশনের নাম হোক কপিল মুনির নামে। তা হলে ভেসেল-নির্ভর যাতায়াতের অনিশ্চতয়তার হাত থেকে মুক্তি মিলবে। তাতে শুধু সাগরের মানুষই উপকৃত হবেন তা নয়, কমবে গঙ্গাসাগরে আসা তীর্থযাত্রী বা পর্যটকদের হয়রানিও।
(চলবে)