মজে যাওয়া এখনকার যমুনা নদী। ছবি: শান্তনু হালদার।
গঙ্গার জল ফের টলটলে করতে শুরু হয়েছে ‘ক্লিন গঙ্গা’ প্রকল্প। কিন্তু যমুনার কী হবে?
এমনই প্রশ্ন করছে গোবরডাঙা। উত্তর ২৪ পরগণার একদা খরস্রোতা যমুনায় এক সময়ে বড় বড় নৌকা চলত। এখন তার গতি স্তব্ধ, জল ঢাকা পড়েছে কচুরিপানার তলায়। বর্ষার জলটুকু বয়ে নিয়ে যাওয়ারও ক্ষমতা নেই, বেশি বৃষ্টি হলেই যমুনার জল নদীর পাশের এলাকায় ঢুকে পড়ে। যাঁদের পূর্বপুরুষ যমুনা দিয়ে নৌকো করে যেতেন, তাঁরাই আশ্রয় নেন ত্রাণ শিবিরে।
গোবরডাঙার জল নিকাশির প্রধান মাধ্যম ওই নদী। কেন তার এই দুর্দশা? তার কারণ, প্রশাসন যমুনা থেকে মুখ ফিরিয়েছে, সেই সুযোগে এক শ্রেণির মানুষ যথেচ্ছ ব্যবহার করছে নদীকে। নদীর জল আটকে ভেড়ি করা হয়েছে। পুরএলাকায় নদীর যে চার কিলোমিটার পড়ছে, তাতে অন্তত ১০টি ভেড়ি রয়েছে। নদীর জল আটকানো বেআইনি, অথচ দু’দশকেও পুলিশ-প্রশাসন নদীকে ভেড়িমুক্ত করতে পারেনি।
গোবরডাঙা কালীবাড়ি এলাকার কাছে সেতুর ওপর দাঁড়ালে দুদিকেই দেখা যায় কচুরিপানার ঘন আস্তরণ। তারই মধ্যে অগণিত ‘ ভেচার’ - বাঁশ পুঁতে জাল দিয়ে জল আটকে মাছ ধরা। ফলে নদীর গতি আটকে গিয়েছে। শহরের বাসিন্দা প্রৌঢ় সমীর নন্দী বলেন, “আমাদের ছেলেবেলায় নদীতে রীতিমতো স্রোত ছিল। জল ছিল পরিষ্কার, স্বচ্ছ। আমরা নিয়মিত এখানে চান করতাম। এখন কচুরিপানার দাপটে চান করার কথা চিন্তাও করা যায় না। নদীর দুই পারের মানুষ মশার দাপটে নাজেহাল।”
অথচ গোবরডাঙার ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে যমুনা। অতীতের গোবরডাঙা ছিল কুশদহ বা কুশদ্বীপের অন্তর্গত। কুশদ্বীপের মধ্যে দিয়ে বয়ে যেত যমুনা নদী। এলাকার মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল এই জলপথ। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, গোবরডাঙার আদি বাসিন্দাদের বেশির ভাগই এসেছিলেন সপ্তগ্রাম থেকে। চার শতক আগে এখানে ছিল আধুনিক জনপদ। ব্যবসা-বাণিজ্যেও সমৃদ্ধ ছিল এলাকাটি। কলকাতা থেকে মাত্র ৫৮ কিলোমিটার দূরের এই শহরে যমুনা নদীর ধারে ছিল বহু চিনি কল। এখান থেকে সারা দেশে চিনি রফতানিও হত। খাঁটুরা উত্তরপাড়াতে ছিল লবণ কারখানা। হত নীল চাষও। সরকার পাড়ায় নীল কুঠির ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন অনেক প্রবীণ। অতীতে যমুনা নদীতে বড় বড় নৌকায় করে পসরা নিয়ে ব্যবসায়ীরা মেলায় হাজির হতেন। মেলায় মশলার হাট বসত। এখনও সেই রীতি বজায় রয়েছে। পয়লা বৈশাখ ওই উত্সবের মাধ্যমেই গোবরডাঙায় নববর্ষের সূচনা হত।
কেন হচ্ছে না সংস্কার? পুরসভার চেয়ারম্যান সুভাষ দত্ত জানান, গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার যমুনা নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে পলি তোলা হয়েছে সেচ দফতরের তরফে। ২০০০ সালের আগে একবার পলি তোলা হয়েছিল। ২০০৬ সাল নাগাদ আরেক বার ড্রেজিং হয়েছিল। কিন্তু নদী থেকে পলি তুলে তা পাড়েই রেখে দেওয়া হয়। বর্ষায় সেই পলি ফের নদীতে নিয়ে মিশে যায়। ফলে টাকাই ধ্বংস হয়েছে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সুভাষবাবু বলেন, “পুরসভার যথেষ্ট টাকা নেই নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করার মতো। তাই বরাদ্দের দাবি জানিয়েছি রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন।” রাজীববাবু বলেন,
নদী যেমন মজছে, পুকুর ভরাটও হচ্ছে বলে অভিযোগ। পুকুরের পাড় বাঁধানোর নাম করে, কিংবা ধার ঘেঁষে অল্প অল্প করে ভরাট করে, কৌশলে ক্রমশ পুকুর বুজিয়ে দিচ্ছেন প্রোমোটাররা। এ ছাড়া রয়েছে অরক্ষিত পুকুরে দুর্ঘটনার ঝঁুকি। বাসিন্দারা এলাকার পুকুরগুলোর চারধারে গার্ডওয়াল দেওয়ার দাবি করছেন দীর্ঘ দিন। এখনও তা হয়নি।
কেবল পুকুর-নদীর জলই নয়, সমস্যা পানীয় জল নিয়েও। গোবরডাঙা এলাকাটি আর্সেনিক প্রবণ। বাড়ি বাড়ি পাইপ লাইনের মাধ্যমে পরিস্রুত পানীয় জল পৌছে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু এখনও গোবরডাঙার প্রায় ১৪ হাজার পরিবারের মধ্যে মাত্র ৯০০ পরিবারে জলের পাইপ গিয়েছে। প্রায় প্রতি এলাকাতে বুড়ি ছোঁয়ার মতো করে অল্প কিছু বাড়িতে পাইপসংযোগ দেওয়া হয়েছে। আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জল না পেয়ে মানুষ হতাশ। সুভাষবাবু দাবি, তাঁরা প্রায় প্রতি পাড়াতেই পানীয় জলের কল বসিয়েছেন। পাইপ না থাকলেও শুদ্ধ জল মিলবে। কিন্তু বাসিন্দাদের অভিযোগ, একটা কল থেকে অত পরিবারের জল নেওয়া সম্ভব নয়। অগত্যা হয় নলকূপের জল, নইলে জলের বোতল কেনা, এ ছাড়া উপায় নেই।
এ নিয়ে ক্ষোভের সুযোগ নিতে জল নিয়ে সরব বিরোধীরাও। সিপিএমের কাউন্সিলরেরা কিছুদিন আগে পুর চেয়ারম্যানের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। পুরসভায় বিরোধী দলনেতা বাপি ভট্টাচার্য দাবি ছিল, তৃণমূল-পরিচালিত পুরসভা মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌছে দেওয়ার। তারা তা পারেনি। পাইপলাইন সম্প্রসারণের কাজও করতে পারেনি।
‘স্বচ্ছ ভারত’-এর ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেই প্রায় আড়াই বছর আটকে রয়েছে যমুনা সংস্কারের পরিকল্পনা। কবে স্বচ্ছ হবে যমুনা, তার আশায় বসে গোবরডাঙা।