হাসনাবাদ বাজার এলাকার দশা। ছবি: নির্মল বসু।
বর্ষা শুরু হতেই নদীতে জল বাড়ায় বাঁধ ভেঙে গ্রাম প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ। ইতিমধ্যে প্লাবিত হয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সুন্দরবনের বহু এলাকা। ত্রাণ নিয়ে অভিযোগও উঠছে।
যদিও বসিরহাট মহকুমা প্রশাসনের দাবি, সর্বত্র জোর কদমে নদীবাঁধ মেরামতির কাজ শুরু হয়েছে। মেরামত করা হচ্ছে স্লুইস গেটগুলি। কিন্তু গ্রামবাসীদের দাবি, একশো দিনের প্রকল্পে কিছু এলাকায় বাঁধে মাটি পড়লেও সুন্দরবনের একটা বড় এলাকায় জুড়ে এখনও নদীবাঁধের অবস্থা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। যে ভাবে বৃষ্টি শুরু হয়েছে এবং নদীর জল বাড়ছে, তাতে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে মেরামতির অভাবে নদী-সংলগ্ন স্লুইস গেটগুলির অবস্থা খুবই করুণ। অনেক ঢাকঢোল বাজিয়ে আয়লার পরে কংক্রিটের যে-বাঁধ তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল, গত ৬ মাস আগে সেই কাজও থমকে গিয়েছে।
এ বিষয়ে রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, আয়লার পরে বাঁধ নির্মাণের জন্য বাম আমলে জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল মাত্র ১২৭ একর। তাঁর দাবি, দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে বড় প্যাকেজের মাধ্যমে মাত্র ৭ জন ঠিকাদারকে ৬৮৫ কোটি টাকার টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল। কাজের আগেই বাম সরকার ওই সব ঠিকাদারকে ১০ শতাংশ টাকাও দিয়ে দেয়। সেই টেন্ডার বাতিল করে টাকা উদ্ধারের পর ছোট ছোট প্যাকেজ করে ইতিমধ্যে দুই ২৪ পরগনায় ২০ কিলোমিটার কংক্রিটের বাঁধের কাজ শেষ করা হয়েছে। আরও ৪৫ কিলোমিটার আয়লা বাঁধের কাজ চলছে। ১ হাজার ৭৮১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার টাকা না দেওয়ায় কিছু কিছু জায়গায় কাজ করতে একটু দেরি হচ্ছে।”
মহকুমা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৯ সালে সুন্দরবন এলাকায় ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর আয়লার ক্ষত এখনও মানুষের কাছে দগদগে ঘায়ের মতো। আকাশে একটু মেঘ জমলেই বাসিন্দাদের বুক দুরুদুরু করে। তাঁরা ভাবেন, এই বুঝি নদীর জল ফুলে ফেঁপে ভয়ঙ্কর আকার নিয়ে বাঁধের উপরে আছড়ে পড়বে।
বছর তিনেক আগে হিঙ্গলগঞ্জের সান্ডেলেরবিল পঞ্চায়েতের সিংহেরআটি, খোসবাস গ্রামে রাজ্যের তৎকালীন সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া কংক্রিটের ৫০০ মিটার বাঁধের শিলান্যাস করেন। ওই দিন উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের তৎকালীন সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী শ্যামল মণ্ডল, খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু প্রমুখ। মন্ত্রীরা জানান, হিঙ্গলগঞ্জ এবং হাসনাবাদের মোট ১৬টি মৌজায় কংক্রিটের বাঁধের কাজ শুরু হল। কিন্তু ওই বাঁধের কাজ ২৫ শতাংশ হওয়ার পরে কংক্রিটের বাঁধের টেন্ডার পাওয়া নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় তদন্তের নির্দেশ দেন। এই পরিস্থিতিতে গত ছ’মাস ধরে বাঁধের কাজ বন্ধ।
সুন্দরবনের একটি বড় অংশ পড়ে সন্দেশখালি ১ এবং ২ ব্লকে। দ্বীপভূমি সন্দেশখালির ১৬টি পঞ্চায়েত এলাকাতে থাকা ১৯টি স্লুইস গেটের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় বলে দাবি করে সন্দেশখালির সিপিএম বিধায়ক নিরাপদ সর্দার সম্প্রতি বিধানসভায় বেহাল নদীবাঁধের বিষয়ে দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাব পেশ করেন।
নিরাপদবাবু বলেন, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বাঁধের জন্য জমি দিলেই চাকরি দেওয়া হবে। সেই কথা রাখতে না পারায় জমি অধিগ্রহণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে।” তাঁর মতে, এর ফলে এক দিকে যেমন উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এলাকার ৭৭৩ কিলোমিটার এলাকায় কংক্রিটের বাঁধের কাজ বন্ধ হয়েছে, তেমনই কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া ৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা খরচের অভাবে ফেরত যেতে বসেছে। সিপিএম বিধায়কের দাবি, বিধানসভায় দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব পেশ করা সত্ত্বেও নদী-বাঁধ কিংবা স্লুইস গেট সংস্কারের কোনও লক্ষণ চোখে পড়ছে না। বিধায়ক জানান, ওই এলাকার সন্দেশখালি, খুলনা, সেহেরা, রাধানগর, বাউনিয়া, জেলিয়াখালি, দুর্গামণ্ডপ, কোড়াকাটি, মণিপুর, আতাপুর, দাউদপুর, দ্বারিকজঙ্গল এলাকার নদীবাঁধের অবস্থা ভয়াবহ। যে-কোনও মুহূর্তে বাঁধ ভেঙে বড় এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নদীতে নেমে মাছ ধরার জন্য ম্যানগ্রোভ নষ্ট হওয়ার কারণে নদী-বাঁধের বড় রকম ক্ষতি হচ্ছে বলেও দাবি বিধায়কের।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সন্দেশখালির খুলনা, শীতলিয়া, আতাপুর, মণিপুর, বোয়ালিয়ার চর, তুষখালি, টোংতোলি, ভোলাকালি, কালীনগর এবং হিঙ্গলগঞ্জের সর্দারপাড়া, পারঘুমটি, কালুতলা, সাহেবখালি এলাকার নদীবাঁধের অবস্থা শোচনীয়। এমনিতেই সুন্দরবন এলাকার বড়কলাগাছি, ডাঁসা, হাতাখালি, রামপুর, ঘাটহারা, সাহেবখালি, বেতনি, রায়মঙ্গল নদীর জল বাড়ায় চিন্তিত ওই সব এলাকার মানুষ। এ বারের বর্ষায় হাসনাবাদ, বাদুড়িয়া, মিনাখাঁ, স্বরূপনগর এবং বসিরহাট এলাকার কোথাও বাধ ভেঙে, কোথাও বাঁধ ছাপিয়ে নোনা জলে ভাসার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পূর্ণিমার ভরা কোটালে নদীতে জল বাড়ার পাশাপাশি যত্রতত্র ইটভাটার ডক তৈরির জন্য বাঁধ কাটা, মেছোভেড়িতে জল ঢোকানোর জন্য স্লুইস গেট নষ্ট করা এবং বাঁধ সংলগ্ন বিঘার পর বিঘা জমিতে মাছ চাষের জন্যও চিন্তিত নদী পাড়ের বাসিন্দারা।
মহকুমা সেচ দফতরের নির্বাহী বাস্তুকার নিরঞ্জন সিংহ বলেন, “সুন্দরবন এলাকায় দু’একটা জায়গা ছাড়া বাকি সব বাঁধে মাটি দিয়ে উঁচু করা হয়েছে। যে-সব বাঁধ সামান্য দুর্বল, সেগুলিতেও মেরামতির কাজ শেষ হয়ে যাবে।”
হিঙ্গলগঞ্জের বিডিও বিশ্বজিৎ বসুর দাবি, টেন্ডার বাতিল হওয়ার জন্য হিঙ্গলগঞ্জের সিংহেরআটি, খোসবাস এলাকায় আপাতত কংক্রিটের বাঁধের কাজ বন্ধ হয়ে আছে। খুব শীঘ্রই তা শুরু হবে। হিঙ্গলগঞ্জের যে যে এলাকায় বাঁধের অবস্থা খারাপ, সেখানেও কাজ শুরু হয়েছে। বাঁধ মেরামতির পাশাপাশি পুরনো স্লুইস গেটের পরিবর্তে নতুন স্লুইস গেট লাগানো হচ্ছে।” ভরা কোটালে নদীর জল বাড়ার আগেই ওই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে দাবি করেন বিডিও।
সাহেবখালির নীলমণি মণ্ডল, কণিকা দাস, সর্দারপাড়ার খগেন মাহাতো, রুক্মিনী সর্দার, বসিরহাটের রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়, আব্দুল গফুররা বলেন, “নেতারা আশার কথা শোনান। আধিকারিকরা প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কাজের কাজ কিছুই হয় না। না হলে কি বেআইনি ভাবে নদীপাড়ের ম্যানগ্রোভ কাটা সম্ভব হত? নাকি বাঁধ কেটে ইটভাটা কিংবা মেছোভেড়ি তৈরি করা যেত?
সকলের গলাতেই সেই পরিচিত অভিমান এবং ক্ষোভের সুর। “আসলে সুন্দরবনে আমাদের মতো প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কষ্টের কথা শোনা বা ভাবার মতো সময়ই নেই কারও।”