বিয়ে করে শীতের রাতে জেলে ফিরলেন যুবক

এক জন প্যারোলে বেরিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ‘পিকে’ দেখে এলেন। তাঁর ভরা সংসারের ছবি শুক্রবারই সংবাদমাধ্যমের পাতায় প্রকাশিত হয়ে কারও আর জানতে বাকি নেই। তিনি বলিউড তারকা সঞ্জয় দত্ত। ব্যাপারই আলাদা। তবে গোপালনগরের সনেকপুর রেললাইন পাড় এলাকার যুবকের কিছু মিল আছে মুম্বইয়ের চিত্রতারকার সঙ্গে। তিনিও প্যারোলে ছাড়া পেলেন শুক্রবার। ঘণ্টা পাঁচেকের জন্য। সঞ্জয় জেল থেকে বেরিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে। আর গোপালনগরের যুবক বেরোলেন কপালে সিঁদুর দিয়ে কাউকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

গোপালনগর শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:৩৩
Share:

অঙ্কন: নির্মাল্য প্রামাণিক।

এক জন প্যারোলে বেরিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ‘পিকে’ দেখে এলেন। তাঁর ভরা সংসারের ছবি শুক্রবারই সংবাদমাধ্যমের পাতায় প্রকাশিত হয়ে কারও আর জানতে বাকি নেই। তিনি বলিউড তারকা সঞ্জয় দত্ত। ব্যাপারই আলাদা। তবে গোপালনগরের সনেকপুর রেললাইন পাড় এলাকার যুবকের কিছু মিল আছে মুম্বইয়ের চিত্রতারকার সঙ্গে। তিনিও প্যারোলে ছাড়া পেলেন শুক্রবার। ঘণ্টা পাঁচেকের জন্য। সঞ্জয় জেল থেকে বেরিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে। আর গোপালনগরের যুবক বেরোলেন কপালে সিঁদুর দিয়ে কাউকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে।

Advertisement

এ দিন এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, মেয়ের বাড়ির উঠোন কলাগাছ, ফুল দিয়ে সাজানো। পলিথিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি হয়েছে ছাদনাতলা। রঙিন কাগজ মোড়ানো দু’টি বিয়ের পিড়ি। বেনারসী শাড়ি পড়ে কনে অপেক্ষা করছেন বরের। আশেপাশে দাঁড়ানো পাড়া-পড়শি, আত্মীয়-স্বজন। বিয়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত পুরোহিত।

ইতিমধ্যে শোনা গেল, বর রওনা দিয়েছেন বাড়ি, থুড়ি বনগাঁ উপসংশোধনাগার থেকে। তাঁকে পুলিশি প্রহরায় নিয়ে আসা হচ্ছে। সঙ্গে আইনজীবী সুজল বিশ্বাস। গাড়ি থামল বরের বাড়ির সামনে। সেখান থেকে বাবা-মাকে প্রণাম করে ছেলে গেল বিয়ে করতে। মেয়ের বাড়িতে যেতেই উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করা হল। এরপরে বিয়ের মন্ত্র পড়ে সাত পাকে বাঁধা পড়লেন দু’জন। তখনও পাশে বসে আইনজীবী ও পুলিশ। সিঁদুর পড়ানো শেষ হতেই মিষ্টিমুখের পালা শুরু। শুক্রবার বিয়ের জন্য জেল থেকে ঘণ্টা কয়েকের জন্য ছাড় পেয়েছিল পাত্র।

Advertisement

বছর উনিশের মেয়েটির সঙ্গে পড়শি যুবকের প্রেমের সম্পর্ক বেশ কিছু দিনের। গাঁয়ে-গঞ্জে এ সব কথা বেশি দিন চাপা থাকে না। এই নিয়ে পাড়ায় সালিশি সভা ডাকা হয়। ওই সভায় মেয়েটিকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেন যুবক। আপত্তি ছিল না দুই পরিবারের। দু’বাড়িতে যাতায়াতও শুরু হয়।

এ পর্যন্ত সব ঠিকই চলছিল। ‘কহানিমে ট্যুইস্ট’ ঘটে কিছু দিন বাদে। কর্মসূত্রে কেরল যান যুবক। ভিন রাজ্যে চোখে কী ঘোর লেগেছিল কে জানে, সেখান থেকে ফিরে পুরনো প্রেমিকাকে আর মনে ধরছিল না। বিয়েতেও বেঁকে বসেন। কিন্তু প্রেমের জোয়ারে তো আগেই বান ডেকেছিল। জানা যায়, অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছেন তরুণী। এখনও বল, বিয়ে করবে না? ছলছল চোখে তরুণীর এই প্রশ্নের সামনেও নাকি গোঁ ধরে বসেছিলেন প্রেমিক। বিয়ে তিনি করবেন না কিছুতেই।

বললেই তো হল না, দেশে আইন-আদালত বলে তো একটা ব্যাপার আছে। গোপালনগর থানায় বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাসের অভিযোগ দায়ের করেন তরুণী। গত ২০ ডিসেম্বর পুলিশ গ্রেফতার করে ওই যুবককে। বিচারকের নির্দেশে জেল হয়। ঘন শীতে জেলের ঠান্ডা মেঝেয় কয়েক রাত কাটানোর ফলেই হোক কিংবা পুরনো প্রেম চাগাড় দেওয়ায় যুবক বিয়েতে মত দেন। তাঁর আইনজীবী সুজল বিশ্বাস ২৪ ডিসেম্বর বনগাঁ মহকুমা আদালতে এসিজেএম গৌরব ঘোষের কাছে আবেদন জানান, ২৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যাবেলা কয়েক ঘণ্টার জন্য প্যারলে মুক্তি দেওয়া হোক তাঁর মক্কেলকে। সুজলবাবু বলেন, “দু’বাড়ির মধ্যে আলোচনা হয়েছে। মেয়েটিকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন আমার মক্কেল।” মিঞা-বিবি রাজি হলে কাজি আর কবে না করেছে! অনুমতি দেন বিচারক। কিন্তু সময় ওই পাঁচটি ঘণ্টাই, মনে থাকে যেন। ‘আজ্ঞে’ বলে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেন যুবক।

সেই মতো জোগাড়যন্তর শুরু হয় দুই বাড়িতে। এই ক’দিনে যতটা করা যায় আর কী। শেষমেশ পুলিশের উপস্থিতিতে শুক্রবার বিয়ে হয়েছে।

কী বলছেন সদ্য বিবাহিতা তরুণী? খুশি খুশি মুখে বললেন, “পাঁচ বছরের সম্পর্ক আমাদের। ভাল তো লাগবেই। আমি আদালতে জানিয়েছি, ওর বিরুদ্ধে আমার আর কোনও অভিযোগ নেই।” মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মা-ও খুশি। বললেন, “বছর খানেক আগে আমরা এই সম্পর্ক জানতে পারি। বিয়ে দিতে রাজি হই। জামাইয়ের বিরুদ্ধে আমাদের আর কোনও ক্ষোভ নেই।” স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, “কয়েক জন বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ওই মেয়েটিকে অস্বীকার করেছিল ছেলেটি। ওদের অনেক দিনের সম্পর্ক। ওদের বিয়ে দেখে খুশি আমরা।” পাত্রের বাবার কথায়, “এই বিয়েতে আমাদের কোনও দিনই আপত্তি ছিল না। ছেলে বাড়ি ফিরলে অনুষ্ঠান করা হবে।” যুবকের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা আদালতে পরের শুনানিতে ঠিক হবে, জানালেন পুলিশ কর্মীরা।

সব শেষে বিয়ের রাতেই বউকে নিজের বাড়িতে রেখে জেলে ফিরে গেলেন পাত্র। পুলিশের গাড়িতে ওঠার সময় করুণ দৃষ্টিতে বউয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। অস্ফূটে বলতে শোনা গেল, “আমারই মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। না হলে এই দিন দেখতে হত না। ফুলশয্যার বদলে জেলের কম্বলের তলায় ফিরতে হচ্ছে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement