প্রচারে বেরিয়েছেন তরুণ কংগ্রেস প্রার্থী। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
পরনে তুঁতে রঙের পাঞ্জাবির উপরে কালো রঙের জহর কোট। সঙ্গে সাদা পাজামা। গলায় কংগ্রেসের পতাকা ঝুলছে। বৃহস্পতিবার সকালে প্রচারে বেরোলেন বছর উনত্রিশের তরুণ তুর্কি কুন্তল মণ্ডল। বনগাঁ লোকসভার উপনির্বাচনে তিনিই এ বার কংগ্রেসের তুরুপের তাস।
কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে ঢুকলেন বনগাঁ শহরের অন্যতম বড় বাজার ট বাজারে। দুই সহকর্মীর হাতে দলীয় পতাকা। অবাক ক্রেতা বিক্রেতা। বনগাঁ লোকসভার উপ-নির্বাচনের কনিষ্ঠতম প্রার্থী এরপর গেলেন সব্জি বিক্রেতা থেকে শুরু করে মাছ বিক্রেতা সকলের কাছে। জোড় হাত করে ভোট চাইলেন। হাত মেলালেন। মুখে বলছেন ‘আর্শীবাদ করবেন’। এক দোকানি দাঁড়িপাল্লায় ফুলকপি তুলেছেন। প্রার্থী গিয়ে হাত এগিয়ে দিতেই দোকানি দাঁড়িপাল্লা রেখে প্রার্থীর সঙ্গে হাত মেলালেন। পাশ থেকে সহকর্মীরা বলে দিলেন, “ও আমাদের কংগ্রেস প্রার্থী।” তাঁদেরকে ‘একটু দেখবেন’ বলে অনুরোধ করলেন কংগ্রেস কর্মীরা। প্রচারের লিফলেট বিলি করা হল সকলের মধ্যে। প্রার্থী একটু দূরে যেতেই চারিদিকে লোকজনকে বলাবলি করতে শোনা গেল, “আরে এ তো খুবই ইয়ং, বাচ্চা ছেলে।” কেউ কেউ তক্ষুণি মন দিয়ে লিফলেট পড়তে শুরু করলেন।
কংগ্রেসের পক্ষ থেকে লিফলেটে অন্য বিষয়গুলি ছাড়াও বলা হচ্ছে, ‘মতুয়া সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক মেরুকরণের বাইরে রেখে সম্মান জানাতে এবং উদ্বাস্তু কল্যাণে বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গী পিআর ঠাকুরের নিঃস্বার্থ মতাদর্শে মতুয়া সম্প্রদায়কে সত্যি দীক্ষিত করতে হলে কংগ্রেস প্রার্থীকে আর্শীবাদ করুন।’ বাজারের বাইরে বেরিয়ে রাস্তার দু’পাশের দোকানগুলিতেও ঢুকে পড়লেন প্রার্থী। কখনও মুদিখানার দোকান কখনও বা কাপড়ের দোকানে ঢুকে সকলের সঙ্গে হাত মেলালেন। রাস্তা দিয়ে যাওয়া এক ভ্যান চালককে দেখে এগিয়ে গিয়ে প্রার্থী তাঁর দুই হাত ধরে মাথায় নিয়ে বললেন, “আর্শীবাদ করুন”। ভ্যানচালক অবাক হয়ে হাসিমুখে আর্শীবাদ করলেন। প্রার্থী চলে যেতেই এক ফল অবশ্য বিক্রেতা বলে ফেললেন, “আর্শীবাদ করেছি। কিন্তু ভোটটা দিতে পারব না।” বনগাঁয় এমনিতে কংগ্রেস বিশেষ শক্তিশালী নয় বহু দিন ধরে। প্রার্থীকে দূর থেকে দেখে এক সাইকেল চালক তাঁর পরিচিত একজনকে বললেন, “আরে, এটা আবার কোন পার্টি!” তবে কুন্তলের ব্যবহারে সকলেই মুগ্ধ। এক বৃদ্ধের কথায় “ভোট ওকে দেওয়াই যেতে পারে।” ঘণ্টাখানেক সময় ধরে প্রচার সেরে প্রার্থী গেলেন বনগাঁ শহর কংগ্রেসের কার্যালয়ে। সেখানে শহর কংগ্রেস সভাপতি কৃষ্ণপদ চন্দের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ নিয়ে ফের বেরিয়ে পড়লেন প্রচারে।
প্রার্থীকে নিয়ে কংগ্রেসের একাংশের মধ্যে অবশ্য ক্ষোভ রয়েছে। সম্প্রতি দলীয় কার্যালয়ের মধ্যেই তাঁকে শারীরিক নিগ্রহ করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী তরুণ প্রার্থীকে সব সময় সাহস ও আত্মবিশ্বাস জুগিয়ে চলছেন। প্রতিনিয়ত প্রার্থী প্রচারের যাবতীয় খোঁজ খবর নিচ্ছেন তিনি।
বনগাঁ শহরের রেলবাজার এলাকার বাসিন্দা কুন্তল বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। মাস পাঁচেক আগে মারা গিয়েছেন বাবা সন্তোষকুমার মণ্ডল। বছর দু’য়েক আগে মারা গিয়েছেন মা অর্চনাদেবীও। নেতাজি ওপেন ইউনির্ভাসিটি থেকে অঙ্কে বিএসসি পাশ করেছেন কুন্তল। নিজে খুব বেশি দিন সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেননি। বাবা সন্তোষবাবু অবশ্য দীর্ঘদিন কংগ্রেস করতেন।
স্বভাব বিনয়ী কুন্তল বললেন, “প্রার্থী আমি নই। প্রার্থী আপনারা সকলেই। যাঁরা বাংলার মানুষ তাঁরা যেন তাঁদের নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দেন।” বক্তৃতা দিতে এখনও সড়গড় হননি। চাঁদপাড়ায় দিন কয়েক আগে অধীর চৌধুরীর সভায় কুন্তল প্রথমে বক্তৃতা দিতে ভয় পাচ্ছিলেন। অধীরবাবুই তাঁর সাহস জুগিয়েছিলেন। সেই সাহসের উপরে ভর করে এগিয়ে চলেছেন তিনি। অনুজিত্ ভট্টাচার্য, বিকাশ গোর, মহিবুল সিদ্দিকী, দেবু চৌধুরী, অসীম দত্তের মতো কয়েকজন সহকর্মী সব সময় পাশে থেকে প্রার্থীকে ভরসা যোগাচ্ছেন। লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী যে জয়ী হতে পারবেন না তা হয় তো কংগ্রেস নেতারাও জানেন। সে কারণে তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, নির্বাচনকে ঘিরে সংগঠনকে চাঙ্গা করে নেওয়া। কৃষ্ণপদবাবু বললেন, “গত লোকসভা ভোটে দলীয় প্রার্থী পেয়েছিলেন ৪৪ হাজারের মতো ভোট। এ বার আমরা প্রচারে মানুষের যে সাড়া ও উত্সাহ দেখছি তা অকল্পনীয়। আমাদের বিশ্বাস এবার অনেক বেশি মানুষের সমর্থন আমরা পাব।”
প্রচারের অভিজ্ঞতা কেমন জানতে চাইলে কুন্তল বলেন, “হরিণঘাটা ও স্বরূপনগর বিধানসভা এলাকায় ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। হরিণঘাটার হিংনাড়া এলাকায় সভা করতে যাওয়ার আগে অনেক আগে থেকেই প্রায় সাড়ে চারশো লোক আমার জন্য দীর্ঘ ক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন। পৌঁছনোর পরে সেখানে আমাকে যে ভাবে স্বাগত জানানো হল, তা ভোলার নয়। হরিণঘাটার সর্বত্র আমাদের সভায় মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি আরপিআই দলের নেতা কর্মীরা কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। ওই দলের নেতা সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস নিজে কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে নেমে পড়ায় গাইঘাটা এলাকাতেও কংগ্রেস প্রচারে সাড়া ফেলতে পেরেছে বলে মনে করছেন দলের নেতারা। নিজেকে মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ হিসাবে দাবি করে কংগ্রেস প্রার্থী জানান, চাকদহের গোরাচাঁদতলায় তাঁদের বাড়িতে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দির আছে। তাঁর জ্যাঠার মতুয়া ভক্তদের নিয়ে একটি দলও আছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পরে বড়মার আর্শীবাদ নিয়ে এসেছেন কুন্তলবাবু। রাজনীতির ময়দানটা যে কঠিন তা অবশ্য এখন বুঝতে পারছেন বিলক্ষণ। তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ হয়েছে। কটূক্তি শুনতে হয়েছে। তবুও হাসি মুখে প্রার্থী বলছেন, “আমি বয়সে ছোট। যদি কোনও ভুল-ত্রুটি থাকে, তাঁরা যেন আমাকে ক্ষমা করে দেন।”
প্রার্থীর এই মনোভাবই তাঁকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলছে, মনে করেন তাঁর সহকর্মীরা।