মঙ্গলবার ভোর ৫টা। কুয়াশার চাদরে মোড়া চারিপাশ। দিনের আলো তখনও সে ভাবে ফোটেনি। যশোহর রোড বা ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে কলকাতা থেকে বনগাঁয় ফিরতি পথে দেখা গেল, যশোহর রোডে যানবাহন বিশেষ নেই। প্রাতর্ভ্রমণে বের হওয়া কিছু লোকজন ছাড়া লোকজন বিশেষ নেই। সড়ক দিয়ে মাঝে মধ্যে দ্রুত গতিতে ছুটে যাচ্ছে ট্রাক। মূলত তা যাচ্ছিল পেট্রাপোল সীমান্তের দিকে।
হাবরার হাটথুবা এলাকায় হঠাত্ চালকের ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখা গেল, সামনে গোটা দশেক ট্রাক দাঁড়িয়ে পড়েছে। লাঠি হাতে জনা দশেক যুবক ছোটাছুটি করছে। যানজটহীন রাস্তায় সারি সারি বনগাঁমুখী ট্রাক দাঁড়িয়ে।
কোন দুর্ঘটনা ঘটল নাকি সাতসকালে?
গাড়ি থেকে নেমে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল, চাঁদার বিল হাতে রীতিমতো ট্রাক চালকদের শাসানো হচ্ছে। যত ক্ষণ না চাঁদা দেবে, তত ক্ষণ ট্রাক এক চুলও সরাতে পারবেন না চালকেরা। চাঁদা দিলেই ট্রাক নিয়ে যাওয়ার অনুমতি মিলছে। চাঁদা দিতে দেরি করলে বাঁশের লাঠি দিয়ে জোরে জোরে কয়েক ঘা পড়ছে ট্রাকের গায়ে। ভাগ্যিস সেই লাঠির ঘা পড়ছে না ট্রাকের চালক-খালাসির গায়ে।
শুধু ট্রাকই নয়, কলকাতা থেকে বনগাঁগামী ট্যাক্সি থামিয়েও চলছে চাঁদার জুলুম। বাংলাদেশি বা বনগাঁর বাইরের লোক রয়েছে গাড়িতে, মনে হলেই তা থামানো হচ্ছে। প্রতিবেদকের গাড়িটা ছেড়ে দেওয়া হল, তার কারণ, চাঁদা আদায়কারীদের সম্ভবত মনে হয়েছিল গাড়িতে স্থানীয় লোকই আছে। কিন্তু ট্রাকের সারি টপকে বের হতে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হল।
এখানেই শেষ নয়, চোংদা মোড় বেলগরিয়াতে একই ছবি। গাইঘাটা থানা এলাকাতে গাইঘাটা বাজার, নহাটা মোড় বকচড়া, চাঁদপাড়া, মণ্ডলপাড়া ও কালুপুর এলাকাতেও এই একই দৃশ্য।
পুলিশহীন ভোরের সড়কে তারা আনন্দ সহকারে চাঁদা আদায়ে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতেও দেখা যাচ্ছিল তাদের। তবে পুলিশের ভয়ে দিনের অন্য সময়ে চাঁদা তুলতে দেখা যাচ্ছে না ওদের। এমনটাই জানালেন যশোহর রোডের উপর দিয়ে যাতায়াত করা গাড়ির চালকেরা। চাঁদার দৌরাত্ম্য কমাতে পুলিশ অনেক রাত পর্যন্ত এই রাস্তায় টহল দিচ্ছে ঠিকই। কিন্তু চাঁদা আদায়ের জন্য এই কারণে ওরা বেছে নিয়েছে ভোরবেলাকে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, চাঁদা তোলার ওই বাহিনীর মধ্যে কেউ কেউ একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকছে। পুলিশকে আসতে দেখলেই তারা ফোনে সহকর্মীদের খবর দিয়ে দিচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে এলাকা ফাঁকা হয়ে যায়। বড়দের বদলে ছোটদের কাজে লাগানো হচ্ছে। তাতে সহানুভূতি পাওয়া যায়। কারণ পুলিশ ছোটদের ধরলেও তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ছেড়ে দেয়।
বনগাঁ-বাগদা সড়কের গাঁড়াপোতা, চাঁদাবাজার, কৃষ্ণচন্দ্রপুর ও গোবরাপুর এলাকাতেও গাড়ি থামিয়ে চলছে চাঁদা তোলার জুলুম। স্থানীয় বাসিন্দদের কাছ থেকে মৌখিক অভিযোগ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর আগেই তারা পালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় সূত্রের খবর, দিন কয়েক আগে গোবরাপুর এলাকায় সন্ধ্যায় সড়কে গাড়ি দাঁড় করিয়ে জোর করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছিল। সে সময়ে পুলিশের এক আধিকারিকের গাড়ি সেখানে চলে আসে। অন্ধকারের মধ্যে প্রথমে জুলুমবাজেরা পুলিশের গাড়ি খেয়াল করতে পারেনি। কিন্তু কাছে আসতেই ওরা বুঝতে পেরে পালায়। গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ ওদের ধাওয়া করেছিল ঠিকই কিন্তু ধরতে পারেননি।
হাবরা থানা সূত্রে জানা গিয়েছে, কালীপুজোয় চাঁদার জুলুম বন্ধ করতে ব্যাপক ধড়পাকড় চলছে। যশোহর রোডে জোর করে চাঁদা আদায়ের জন্য এখনও পর্যন্ত ২৫ জন গ্রেফতার হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। অনেক পুলিশ অফিসারেরা জানেনই না যে ওই রাস্তায় ভোরবেলায় পুলিশের কোনও টহল থাকে না।
উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “সড়কে কোনও ভাবেই চাঁদা তুলতে দেওয়া হবে না। আরও কড়া পদক্ষেপ করা হচ্ছে।” তা ছাড়া, এ বার থেকে ভোরেও যশোহর রোডে পুলিশি টহল চলবে বলে তিনি জানান।