গ্রামে ঢুকেছে নোনা জল, ভেলায় ভেসে বেড়াচ্ছেন সাগরের মানুষ

সোমবার বেলা সাড়ে ১০টা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। সাগরের গঙ্গাসাগর পঞ্চায়েতের বেগুয়াখালি গ্রামে ঢোকার রাস্তায় হাঁটু সমান কাদা। অন্য দিকে, সমুদ্রের গর্জন। তার মধ্যেই থার্মোকল দিয়ে ভেলা তৈরি করেছেন জেসিনা বিবি। রবিবার রাতের কোটালে সমুদ্রের জলে তলিয়ে গিয়েছে তাঁর বাড়ি। থার্মোকলের ভেলায় ভাসতে ভাসতে বললেন, “খোঁজ নিচ্ছি, কার বাড়িতে ওঠা যায়।”

Advertisement

দিলীপ নস্কর

ডায়মন্ড হারবার শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৪ ০১:১৮
Share:

সাগরের বোটখালি গ্রামে জল থেকে বাঁচতে ঘরের চালই আঁকড়েছেন এক মহিলা।

সোমবার বেলা সাড়ে ১০টা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। সাগরের গঙ্গাসাগর পঞ্চায়েতের বেগুয়াখালি গ্রামে ঢোকার রাস্তায় হাঁটু সমান কাদা। অন্য দিকে, সমুদ্রের গর্জন। তার মধ্যেই থার্মোকল দিয়ে ভেলা তৈরি করেছেন জেসিনা বিবি। রবিবার রাতের কোটালে সমুদ্রের জলে তলিয়ে গিয়েছে তাঁর বাড়ি। থার্মোকলের ভেলায় ভাসতে ভাসতে বললেন, “খোঁজ নিচ্ছি, কার বাড়িতে ওঠা যায়।”

Advertisement

ভরা কোটালে বঙ্গোপসাগরের বাঁধ ভেঙে তিন দিন ধরে বিপর্যস্ত সাগরের বিভিন্ন এলাকা। ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গিয়েছে ধবলাট পঞ্চায়েতে বোটখালি গ্রামের সোমা মালের বাড়ি। চারদিকে জল। জল ঢুকেছে ফসলি জমিও নদীর চেহারা নিয়েছে। সোমাদেবী তাঁর ছোট্ট প্রতিবেশী সুমি খাটুয়াকে নিয়ে একটু আশ্রয়ের জন্য আঁকড়ে ধরেছেন খড়ের চালটুকু। অনেকেই বেরিয়ে পড়েছেন আত্মীয়দের বাড়ি যাবেন বলে।

কচুবেড়িয়া ঘাটে ব্যাগ-ভর্তি জামা কাপড় নিয়ে ভেসেলে উঠেছেন মুড়িগঙ্গা পঞ্চায়েতের পাখিরালা গ্রামের সুশীলা জানা। বললেন, “আজ সকালেই মুড়িগঙ্গা নদীর বাঁধ ভেঙেছে। বাড়িতে কোমরসমান জল দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কোনও রকমে পালাচ্ছি। স্বামী ওখানেই আছে। সব দেখবে। ননদের বাড়ি যাচ্ছি।” তিন ছেলেমেয়ের সঙ্গে সুশীলা নিয়েছেন তাঁর গরু, ছাগলটিকেও। জানালেন, রাতে রান্না করতে পারেননি। বাচ্চাদের পেটে পড়েনি কিছুই।

Advertisement

ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, নদী ও সমুদ্র বাঁধ ভেঙে গোটা সাগর ব্লকের মুড়িগঙ্গা ১ ও ২, ধসপাড়া, গঙ্গাসাগর, ঘোড়ামারাএই পাঁচটি পঞ্চায়েত এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গৃহহীন হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। কৃষিজমি, মাছের পুকুর, পানের বরজে নোনা জল ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, এখনও ত্রাণ এসে পৌঁছয়নি এলাকায়। বোটখালি, বেগুয়াখালি গ্রামের বাসিন্দা পৃথ্বীরাজ ডাকুয়া, তপন জানা, ভবতোষ মাইতিদের ক্ষোভ, “পাঁচ বছর ধরে বাঁধ ভেঙে পড়ে রয়েছে। ভোটের সময় সব দলের নেতারা এসে বলে গিয়েছিল, তারা জিতলেই বাঁধ সংস্কার করে দেবে। ভোট ফুরিয়ে গিয়েছে। কোনও নেতারই আর পা পড়ছে না এলাকায়।”

নামখানা ব্লকের নারায়ণপুর, নামখানা, মৌসুনি, শিবরামপুর, হরিপুর পঞ্চায়েত এলাকায় মুড়িগঙ্গা, হাতানিয়া দোহানিয়া নদীবাঁধ ভেঙেও প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। সমুদ্রের বাঁধ ভেঙে মৌসুনি পঞ্চায়েতের বালিয়াড়া, কুসুমতলা বা বাগডাঙা গ্রাম এখন প্রায় জলের জলের তলায়। ওই এলাকাতেও এখনও কোনও ত্রাণ আসেনি বলে অভিযোগ। খোলা আকাশের তলায় রাস্তার উপর আশ্রয় নিয়েছেন গ্রামবাসীরা। স্থানীয় হাইস্কুলের শিক্ষক গোবিন্দ গিরির ক্ষোভ, “প্রশাসন থেকে এখনও এখানে কেউ এলেন না। ত্রিপল, ত্রাণ কিছুই পাইনি। গরু ছাগল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি আমরা। খোলা আকাশের তলায় রাত কাটছে। কবে ত্রাণ আসবে, বলতে পারেন?”

জল ঢুকছে বেগুয়াখালি গ্রামে। ছবি: নির্মল বসু ও দিলীপ নস্কর।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির সঙ্গে দেখা করতে গেলেই ক্ষোভের মুখে পড়ছেন পঞ্চায়েত প্রধানেরা। তবে তাঁরা অবশ্য তা স্বীকার করেননি। কাকদ্বীপের মহকুমাশাসক অমিত নাথ অবশ্য বলছেন, “ব্লক আধিকারিকদের পরিদর্শনে যাওয়ার জন্য বলেছি।”

সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ভরা কোটালের জলো বাঁধ উপচে এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে খবর পেয়েছি। এলাকার ব্লক আধিকারিকদের খবর দেওয়া হয়েছে। ওই এলাকায় দ্রুত সরকারি সাহায্য পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জল নামলেই সেচ দফতর থেকে বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু হবে।”

এ দিনই গোসাবার দয়াপুরে প্রায় ৩০ ফুট নদীবাঁধ ভেঙে জল ঢুকে পড়ে। সেচ দফতরের কর্মীরা গেলে গ্রামবাসীরা তাঁদের ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখান। মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ। সুন্দরবনের সজনেখালি রেঞ্জের কর্মীরা গ্রামে গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করেন। সেচ দফতর সূত্রে খবর, ওই এলাকায় বাঁধ ভেঙে প্রায় ৫০-৬০ বিঘা জমি নোনাজলে প্লাবিত হয়েছে। গোসাবার সেচ দফতরের আধিকারিক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী বলেন, “জল ঢোকার খবর পেয়ে আমাদের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গেলে তাঁদের মারধর করা হয়েছে। আমরা ওই বাঁধ মেরামতির কাজ শুরু করেছি।” মাতলা নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ক্যানিংয়ের থুুমকাঠি এলাকা। প্রায় কুড়ি ফুট নদীবাঁধ ভেঙে গ্রামে জল ঢুকে পড়ে। বাঁধের ধারের ৩১টি পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে যান ক্যানিং ১ ব্লকের বিডিও বুদ্ধদেব দাস ও পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পরেশ দাস। বুদ্ধদেববাবু বলেন, “কিছু পরিবারকে বাঁধের পাশ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রামে ত্রিপল পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।”

সহ প্রতিবেদন: সামসুল হুদা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement