ধৃত সেই ‘রবিনহুড’। নিজস্ব চিত্র।
খুনের অভিযোগে তেইশ দিন ধরে দু’টি থানার পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেরিয়েছে। সম্ভাব্য সব এলাকায় পুলিশের বিশাল বাহিনী তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালিয়েছে। অবশেষে, রবিবার ভোর রাতে গোপালনগর থানার পুলিশ গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বনগাঁর মতিগঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেফতার করল ‘সুপারি কিলার’ স্বপন সর্দারকে। পুলিশ জানিয়েছে, পুলিশের চোখে ফাঁকি দিতে স্বপন তার গোঁফ-দাড়ি কেটে ফেলেছিল। রবিবার বনগাঁ মহকুমা আদালতে তোলা হলে বিচারক কুখ্যাত এই অপরাধীকে ১০ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, স্বপনের বিরুদ্ধে খুন, তোলাবাজি, অপহরণ, বেআইনি অস্ত্র রাখা-সহ পুলিশের খাতায় বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। তাকে জেরা করে দলের বাকিদের খোঁজেও তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ।
কে এই স্বপন সর্দার?
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর পঁয়তাল্লিশের স্বপনের বাড়ি গোপালনগর থানার মোল্লাহাটি এলাকায়। এলাকার মানুষের বিপদে-আপদে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো দীর্ঘ দিনের অভ্যাস স্বপনের। আর্থিক সাহায্য করা কিংবা কাজ খুঁজে দিয়ে গ্রামের অনেকের উপকারে লেগেছে সে। কিন্তু পুলিশের খাতায় তার বিরুদ্ধে অপরাধের তালিকা দীর্ঘ। কিন্তু তোলাবাজির টাকা নানা সময়ে এলাকায় দু’হাতে বিলিয়েছে সে। কাঁধে বন্দুক নিয়ে মোটর বাইকে করে সে এলাকায় দাপিয়ে বেড়াত। গলায় ঝুলত গুলির বেল্ট। কিন্তু এ হেন ‘রবিনহুড’টিতে গ্রাম থেকে গ্রেফতার করা পুলিশের পক্ষে ছিল কঠিন কাজ। কারণ, এলাকায় তার ভাবমূর্তি ছিল অন্য রকম। ফলে গ্রামবাসীদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধের আশঙ্কা ছিল বলে জানাচ্ছেন পুলিশ কর্তাদের একাংশ।
কিন্তু স্বপনের অপরাধের তালিকা দিন দিন বেড়েই চলায় পুলিশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। গত ১০ অক্টোবর বনগাঁর গাঁড়াপোতার বাসিন্দা পুরনো দুষ্কৃতী সাত্তার মণ্ডলকে দুষ্কৃতীরা কলমবাগান এলাকায় ভরসন্ধ্যায় একটি দোকানের মধ্যে গুলি করে, কুপিয়ে খুন করে। সাত্তারের পরিবারের তরফে স্বপন ও তার দলবলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। ওই খুনের ঘটনায় চার জন গ্রেফতার হলেও স্বপন ছিল অধরাই। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, পুরনো শত্রুতার জেরেই সাত্তারকে খুন হতে হয়েছিল।
গত ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় দুষ্কৃতীরা গোপালনগর থানার খাবরাপোতা এলাকায় ইউনুস মণ্ডল নামে এক যুবককে গুলি করে খুন করে। ওই ঘটনাতেও ইউনুসের পরিবারের তরফে স্বপন-সহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। ঘটনার পর দিন স্বপন-সহ বাকি অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবিতে এলাকার মানুষ গাছের গুঁড়ি ফেলে ছ’ঘণ্টা বনগাঁ-বাজিতপুর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান। বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক বিশ্বজিত্ দাস ঘটনাস্থলে গেলে তাঁকে ঘিরেও বিক্ষোভ দেখানো হয়। রবিবার বিশ্বজিত্বাবু বলেন, “ক’টা দিন দেরি হলেও পুলিশ যে স্বপনকে গ্রেফতার করেছে, তাতে এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কমবে। পুলিশকে বলা হয়েছে, সব দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে।”
ইউনুসের উপরে হামলার পরে পুলিশ চার জনকে গ্রেফতার করলেও এত দিন স্বপনের হদিস পায়নি। ওই ঘটনায় সুখরঞ্জন বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তিও গুলিতে জখম হয়েছিল। সে এখন আরজিকর হাসপাতালে চিকিত্সাধীন। রবিবার ভোরে পুলিশ স্বপনকে খাবরাপোতার ঘটনায় গ্রেফতার করে। বনগাঁ মহকুমা আদালতের মুখ্য ভারপ্রাপ্ত সরকারি আইনজীবী সমীর দাস বলেন, “বিচারকের কাছে ১৪ দিনের পুলিশি হেফাজতের আবেদন করা হয়েছিল। বিচারক ১০ দিন মঞ্জুর করেছেন। স্বপনের বিরুদ্ধে খুন, তোলাবাজি, অপহরণ-সহ নানা অভিযোগ রয়েছে। অতীতে পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করেছিল। কয়েক বছর আগে সে জামিনে ছাড়া পেয়েছিল।” পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সাত্তার খুনের অভিযোগেও স্বপনকে বনগাঁ থানা নিজেদের হেফাজতে নিতে চেয়ে আদালতে আবেদন করবে।
ইউনুসকে কেন খুন করা হলে?
পুলিশের দাবি, জেরায় স্বপন জানিয়েছে স্থানীয় সুন্দরপুর মোড়ে কিছু লোক জোর করে দোকানপাট বন্ধ করে দিচ্ছে এই খবর পেয়ে তারা সেখানে যায়। গুলি চালায়। তবে ইউনুসকে খুন করার উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গোটা বনগাঁ মহকুমা ও নদিয়া জেলায় স্বপনের অবাধ বিচরণ। মূলত স্থানীয় বামনডাঙা বেলেডাঙার মতো এলাকার দুষ্কৃতীদের সঙ্গে স্বপনের বিরোধ দীর্ঘদিনের।