ডাঁসা নদীর এই বাঁধ জোড়াতালি দিয়ে সংস্কার করেন গ্রামবাসীরাই। নিজস্ব চিত্র
বৃদ্ধ গোকুল সিংহ সস্ত্রীক থাকেন দরমার বেড়া দেওয়া ছোট্ট এক চিলতে ঘরে। সে ঘর সংলগ্ন শৌচাগার নেই। যেতে হয় খালের ধারে। আমপানে ডাঁসা নদীর বাঁধ ভেঙে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বাড়িঘর। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দরমার বেড়া দেওয়া ঘরটুকু করে দেওয়া হয়েছিল। সেটাই ভরসা। গোকুলের ক্ষমতা নেই, আমপানের ক্ষত মেরামত করার। বিকলাঙ্গ গোকুল কাজকর্ম করতে পারেন না। স্বামী-স্ত্রী বার্ধক্য ভাতার ২০০০ টাকা পান। আর পান রেশনের চাল। পানীয় জলও কিনে খেতে হয়। এ ভাবেই কোনও রকমে বেঁচে আছেন হাসনাবাদ ব্লকের পাটলি খানপুর পঞ্চায়েতের ২৪ বিঘা পাড়ার বাসিন্দা গোকুল।
গ্রামের আর এক বাসিন্দা শোভারানি সিংহ দরমার বেড়া আর ত্রিপল ঘেরা ঘরে থাকেন। জানালেন, আমপানের আগে চারটি ছোট ছোট ঘরের বাড়ি ছিল। সব ভেঙে যায় নদীবাঁধ ভেঙে জল ঢুকে। তারপরে ছোট দু’টি ঘর করেছেন দরমার বেড়া দেওয়া। আমপানে মুদির দোকানের সব মালপত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আর ক্ষমতা ছিল না ব্যবসা দাঁড় করানোর। বাড়িতে পাকা শৌচাগারটুকুও নেই।
এই পাড়ায় প্রায় ৫০টি আদিবাসী পরিবারের বাস। চারিদিকে দারিদ্রের চিহ্ন স্পষ্ট। গ্রামের যে বাঁধ ভেঙে আমপানে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল, সেই নদীবাঁধ সরকারি ভাবে সংস্কার করা হয়নি দীর্ঘ দিন ধরে। এমনই অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। কবিতা সিংহ জানান, আমপান-ইয়াসের পরেও বাঁধ মেরামত করা হয়নি সরকারি ভাবে। ২৪ বিঘা এলাকার পুরুষেরা মাটি কেটে বাঁধের ভাঙা অংশে দেন। কবিতা বলেন, "বাঁধ আরও ভাল করে সংস্কার করা দরকার। না হলে ফের প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে ভেঙে যেতে পারে। স্থানীয় প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই। আমাদের সঙ্গে শুধু যেন ভোটের সম্পর্ক!"
গ্রামে ঢোকার যে মূল রাস্তা, সেই রাস্তার বড় অংশ এবড়ো খেবড়ো মাটির। সাইকেলও চালানো যায় না। স্থানীয় বাসিন্দা মঞ্জুরি সিংহের কথায়, ‘‘গ্রামের ভিতরের মূল রাস্তার অনেকটা অংশ বহু বছর ধরে মাটির। আমপানে ও ইয়াসে এই গ্রাম ডুবেছিল নদীর জলে। তাতে রাস্তার মাটি ধুয়ে যায়। সেই ক্ষততেও প্রলেপ পড়ল না এখনও।’’ মঞ্জুরির কথায়, "আমরা কেন যে ভোট দিই, নিজেরাই জানি না। বার বার মনে হয়, হয় তো সমস্যাগুলো মিটবে। কিন্তু কোনও ভোটের পরেই কিছু হয় না।’’ গ্রামের বাসিন্দা, গোবরা সিংহ জানালেন, মাটির রাস্তায় একটু বৃষ্টি হলেই ভ্যান, বাইক, সাইকেল কিছুই চলে না। বর্ষার সময়ে মাটির রাস্তার জন্য কেউ অসুস্থ হলে গ্রাম্য চিকিৎসকও বাড়ি আসতে চান না।
ঘেরিপাড়া, ২৪ বিঘা এলাকার কোথাও পানীয় জল বাড়িতে আসেনি। এই চত্বরে কোথাও পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। হতদরিদ্র পরিবারগুলিকে আজও পানীয় জলের ব্যারেল কিনে খেতে হয়। তা-ও বৃষ্টি হলে গ্রামের ভিতরে ভ্যান ঢোকে না। ব্যারেল কিনে অনেকটা দূর থেকে আনতে হয়। স্থানীয় বাসিন্দা চঞ্চলা সিংহ বলেন, "মেয়েটা আঠারো বছরে পা দিয়েছে। খালে-বিলে চায় না। অথচ, কোনও দিন একটা শৌচালয় পেলাম না বাড়িতে।’’ এই অবস্থা গ্রামের বহু বাড়িতে।
গোবরার কথায়, "গ্রামে কোনও কাজ নেই। সব পুরুষ ভিন্ রাজ্যে শ্রমিকের কাজে গিয়েছেন। সকলে ভোট দিতে বাড়ি আসেন। কিন্তু আমরা দীর্ঘ দিন ধরে নেতাদের কাছে দাবি করছি পানীয় জল, পাকা রাস্তা, মজবুত নদীবাঁধ ও পাকা শৌচাগার করা হোক। একটাও দাবি পূরণ হল না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘নেতারা আশ্বাস দেন। তারপরে ভোট মিটলে আর গ্রামে পা রাখেন না।"
পাটলি খানপুর পঞ্চায়েতের প্রধান পারুল গাজির অবশ্য দাবি, সব বাড়িতেই নাকি পাকা শৌচাগার হয়ে গিয়েছে। প্রধান বলেন, "মাটির রাস্তা পাকা হয়ে যাবে দ্রুত। পানীয় জলের সমস্যা পঞ্চায়েত এলাকা জুড়েই আছে। কাজ চলছে। তাড়াতাড়ি সমস্যার সমাধান হবে। বাঁধ সংস্কারের কাজও হচ্ছে।"