সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার পরে গ্যাস বেলুনের কারবারে রাশ টানার দাবি তুলেছেন বহু মানুষ। ফাইল ছবি।
ঘটনা ১: ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস। বনগাঁর সাতভাই কালীতলা এলাকায় প্রাচীন কালীমন্দিরকে কেন্দ্র করে মেলা বসেছিল। গোটা পৌষ মাস জুড়েই চলে মেলা। হাজার হাজার মানুষ আসেন। মেলায় গ্যাস বেলুন বিক্রি করছিলেন এক ব্যক্তি। রাত ৮টা নাগাদ আচমকা গ্যাসের সিলিন্ডার ফেটে যায়। দশ ফুট উপরে উড়ে গিয়েছিলেন দোকানি। গুরুতর জখম হন। বিস্ফোরণে আশপাশের বাড়ির দেওয়ালে ফাটল দেখা দেয়। জানলার কাচ ভাঙে। পুলিশি তদন্তে জানা যায়, সিলিন্ডারে কার্বাইড রাখার ফলেই ওই বিপত্তি হয়েছিল।
ঘটনা ২: রবিবার রাতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর ও বকুলতলা থানার কাছে উত্তর পদুয়া এলাকায় একটি মেলায় গ্যাস বেলুন তৈরির সিলিন্ডার ফেটে মৃত্যু হয়েছে দুই শিশু-সহ চার জনের।
গোটা রাজ্য জুড়ে এমন উদাহরণ আরও আছে। বিপজ্জনক জেনেও দিনের পর দিন মেলা, খেলা, রাজনৈতিক জনসভা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, জলসায় ভিড়ের মধ্যে গ্যাস বেলুনের কারবার চলে। এ সবের উপরে কোনও নজরদারি থাকে না বলে অভিযোগ।
সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার পরে গ্যাস বেলুনের কারবারে রাশ টানার দাবি তুলেছেন বহু মানুষ।
গ্যাস বেলুনের কারবার কতটা বিপজ্জনক?
বনগাঁ শহরের বাসিন্দা, রসায়নের প্রাক্তন শিক্ষক হরিনারায়ণ সরকার জানান, গ্যাস সিলিন্ডারের মধ্যে কার্বাইডের সঙ্গে জল মিশিয়ে অ্যাসিটিলিন গ্যাস তৈরি করা হয়, যা খুবই দাহ্য।
সিলিন্ডারের মধ্যে থেকে প্রবল চাপে গ্যাস বের হয়। অনেক সময়ে সেই চাপ সিলিন্ডারের সহনশীলতার বেশি হয়ে যায়। তখনই ঘটে বিস্ফোরণ।
তা ছাড়া, কার্বাইডের সঙ্গে জল মিশিয়ে অ্যাসিটিলিন গ্যাস তৈরির সময়ে সামান্য পরিমাণ কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হলেও সিলিন্ডার ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।
বিষয়টি জানা সত্ত্বেও বেলুন কারবারিদের মধ্যে কার্বাইড ব্যবহারে প্রবণতাই বেশি। কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেল, বাজারে কার্বাইড সহজলভ্য। সিলিন্ডার কিনতেও খুব একটা বেগ পেতে হয় না। কম খরচে, সহজেই অ্যাসিটিলিন গ্যাস তৈরি করতে পারেন কারবারিরা।
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, গোটা প্রক্রিয়াটি খুবই বিপজ্জনক। প্রতিপদে সতর্কতা জরুরি। সিলিন্ডারে যদি ময়লা পড়ে, জং ধরে যায় বা দীর্ঘ দিন অব্যবহৃত অবস্থায় থাকে, তা হলে বিস্ফোরণের আশঙ্কা বাড়ে।
তা ছাড়া, জলে কার্বাইড মিশিয়ে অ্যাসিটিলিন গ্যাস তৈরির পদ্ধতিটিও বিপজ্জনক। নিরাপদ ভাবে এই গ্যাস তৈরির জন্য রীতিমতো প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি।
বনগাঁ শহরের বাসিন্দা, প্রাক্তন এক গ্যাস বেলুন বিক্রেতা জানালেন, একবার তাঁরও গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে গিয়েছিল। তিনি জখম হন। তারপরে ওই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘খুবই বিপজ্জনক কাজ। জীবনের ঝুঁকি থাকে।’’
রসায়ন বিশেষজ্ঞেরা অনেকেই মনে করছেন, সাধারণত বেলুনে হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহার করার কথা। এই গ্যাস ব্যবহারে বিপদ কম। কিন্তু গ্যাস বেলুন বিক্রেতারা অ্যাসিটিলিন গ্যাস ব্যবহারেই স্বচ্ছন্দ। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, অনেক গ্যাস বেলুন বিক্রেতা বাড়িতে বসে অ্যালুমিনিয়াম, জল এবং কস্টিক সোডা মিশিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করেন। এর ফলে বিপদ বহু গুণ বেড়ে যায়।
অন্য দিকে, মেলায় ব্যবহার করা সিলিন্ডারের মান ঠিক আছে কি না, তা দেখার কোনও ব্যবস্থা নেই। ভিড়ের মধ্যে সিলিন্ডার রেখে গ্যাস বেলুন বিক্রি করা যায় কি না, সে বিষয়ে ধোঁয়াশায় পুলিশকর্তারা।
এক পুলিশ আধিকারিকের কথায়, ‘‘বিষয়টি নিশ্চয়ই কোনও শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। না হলে আমরা জানতাম।’’
এই ধরনের কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশের পক্ষ থেকে মেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। অধিকাংশ মেলার নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকে পুলিশের উপরে।
অনুমতি দেওয়ার আগে প্রশাসনও সব দিক খতিয়ে দেখে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মেলায় জুয়া-সাট্টা হচ্ছে কি না, তার উপরে নজরদারি চলে। সিলিন্ডারের উপরে নজর রাখা হয় না। বিষয়টি মেলা কমিটির উপরে বর্তায়।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ জয়নগরের ঘটনার পরে নড়েচড়ে বসেছে। অন্য দিকে, বারাসতের পুলিশ সুপার রাজনারায়ণ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মেলার নিরাপত্তার উপরে নজরদারি চলে। তবে সিলিন্ডারের বিষয়টি এত দিন নজরে রাখা হত না। এখন থেকে সিলিন্ডারের উপরেও নজরদারি চলবে। থানাগুলিকে সে ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’