প্রণব মুখোপাধ্যায়।
রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে ষাটের দশকে আমতলার কাছে বিদ্যানগর কলেজে অধ্যাপনা করতেন প্রণব। রোজ হাওড়ার বাড়ি থেকে আসতেন আমতলায়। দিনভর ক্লাস নিয়ে সন্ধ্যায় কলেজের সামনেই একটি চায়ের দোকানে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরতেন।
সেই বিদ্যানগর কলেজে এখনও উজ্জ্বল প্রণবের নানা স্মৃতি। কিছু দিন কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বও সামলেছেন তিনি। প্রাক্তন অধ্যক্ষদের তালিকায় এখনও জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম। কলেজে যে ঘরে বসতেন, সেটিকে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। সংরক্ষণ করা হয়েছে তাঁর চেয়ারও।
পরে জীবনের গতিপথ বদলে যায় মানুষটির। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তখন প্রথম সারির মুখ প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরেও একাধিকবার কলেজে এসেছেন তিনি। নানা ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। সে সব ছবি, ফলকও রয়েছে বিদ্যানগর কলেজের অলিন্দে অলিন্দে।
তবে প্রণবের প্রিয় সেই চায়ের দোকানটি আর নেই। মারা গিয়েছেন দোকানি বিমল জানা। বিমলের পরিবারের সদস্যদের মনে অবশ্য প্রণবের স্মৃতি তাজা। বিমলের ভাইপো শঙ্কর জানান, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলানোর সময়েও যতবার কলেজে এসেছেন প্রণববাবু, বিমলের খোঁজ নিতে ভোলেননি। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে কলেজে এক অনুষ্ঠানে এসেও বিমলের সঙ্গে দেখা করেছেন।
প্রায় আট বছর আগে একবার বিদ্যানগর কলেজে এসেছিলেন প্রণব। তিনি তখন দেশের রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির সম্মানে কলেজে বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রণবের ইচ্ছাতেই সেই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র পৌঁছেছিল চা দোকানি বিমলের কাছে। কিন্তু তত দিনে বয়সজনিত কারণে প্রায় শয্যাশায়ী বিমল। তার উপরে পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙেছে। উঁচু মঞ্চের অনুষ্ঠানে তাই যাওয়া হয়নি তাঁর। কিন্তু প্রণব আসবেন শুনে কোনও রকমে ঘর থেকে বেরিয়ে চুপ করে বসেছিলেন দোকানের সামনে। যদি প্রিয় দোকানে একবার আসেন রাষ্ট্রপতি, এই আশায়। নিরাশ করেননি প্রণব। যাওয়ার পথে সেই দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে কথা বলে যান বিমলের সঙ্গে। খবর নেন শরীরস্বাস্থ্যের। শঙ্করের কথায়, “কাকা খুব খুশি হয়েছিলেন সে দিন। যত দিন বেঁচে ছিলেন, বার বার বলতেন সেই কথা।’’ শঙ্কর শুনেছেন, যখন দোকানে আসতেন, প্রণববাবুর চা খাওয়ার একটা নির্দিষ্ট কাপ ছিল। সেই কাপটাও দীর্ঘ দিন যত্ন করে রেখেছিলেন বিমল।
আরও একজনের মনে তাজা প্রণবের স্মৃতি। তিনি কলেজে প্রণবের সহকর্মী প্রদ্যোৎকুমার মণ্ডল। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে প্রণব কলেজ ছাড়ার আগে পর্যন্ত দু’জনে এক সঙ্গেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াতেন। পরে কলেজের জন্য দরবার করতে দিল্লির গিয়েছেন বহুবার। পুরনো সহকর্মীর মৃত্যুসংবাদে ভেঙে পড়েছেন বছর বিরাশির বৃদ্ধ। একে একে ভিড় করছে নানা স্মৃতি। প্রদ্যোৎবাবু বলেন, “পোস্ত খেতে খুব ভালবাসতেন। কলেজের ক্যান্টিনে ভাত, ডাল, আলু-পোস্ত ছিল আমাদের রোজকার খাবার। আমার তো মনে হয়, পোস্তর প্রতি ভাল লাগা থেকেই পরবর্তীকালে অর্থমন্ত্রী হয়ে উনি পোস্ত আমদানির শুল্ক কমিয়ে দিয়েছিলেন।”
প্রদ্যোৎবাবু বলে চলেন, “অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল ওঁর। যখন পড়াতেন, তখন যেমন দেখেছি, তেমনই প্রশাসনিক কাজকর্ম করার সময়েও সেটা লক্ষ্য করেছি। টেনশন থেকে নিজেকে বের করে আনার উপায়টাও জানতেন। ভালবাসতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে। টেনশন হলেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতেন।” প্রদ্যোৎ বলেন, “খুব মজাও করতেন। একবার হয়েছে কী, এক ছাত্র আমাদের জন্য প্রচুর আম নিয়ে এসেছে। তা প্রণবদা-সহ আমরা কয়েকজন মিলে সেই আম সাবাড় করে দিয়েছি। অধ্যক্ষের জন্য রাখা হয়নি। এ দিকে, আমের খবর পেয়ে অধ্যক্ষ প্রণবদাকে ডেকে জানতে চান, তাঁর আম কোথায়। আমরা তো লজ্জায় পড়ে যাই। প্রণবদা দেখি অবলীলায় বলে দিলেন, আম খুব টক ছিল, তাই আপনাকে দেওয়া হয়নি। প্রিন্সিপাল শুনে খুশি হলেন। অথচ অমন সুস্বাদু আম আমি আর খাইনি”— বলতে বলতে একগাল হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বৃদ্ধের মুখ।