জনজোয়ার: দণ্ডমহোৎসব উপলক্ষে সঙ্কীর্ণ গলিতে উপচে পড়া ভিড়। রবিবার, পানিহাটিতে। ছবি: সুমন বল্লভ
কখনও পাঁচিল ভেঙে পড়ার আতঙ্কে ছোটাছুটি। কখনও রেলগেট পড়ে যাওয়ায় আটকে থাকা পুণ্যার্থীদের ক্রমবর্ধমান ভিড়ের চাপ। কখনও আবার পুণ্যস্নান সেরে ফেরার পথে ভেসেল ধরার হুড়োহুড়ি!— গত কয়েক বছরে পুণ্য অর্জনের লক্ষ্যে বেরিয়ে এই সব কারণে পদপিষ্ট বা অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে একাধিক বার। কখনও একসঙ্গে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের, কখনও মৃতের সংখ্যা ১০ ছাড়িয়েছে। রাজ্যের বাইরে মধ্যপ্রদেশের রতনগড়মাতা মন্দিরের কাছে সেতুতে কিংবা কেরলের শবরীমালা মন্দিরে এমন ঘটনায় মৃতের সংখ্যা আবার ছিল একশোরও বেশি।
পানিহাটির মহোৎসবতলা ঘাটে রবিবারের দণ্ডমহোৎসবের ঘটনা সেই তালিকাকে আরও দীর্ঘ করল বলে মনে করা হচ্ছে। যেখানে রাত পর্যন্ত তিন জনের মৃত্যু হয়েছে বলে খবর। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ভিড়ের মধ্যে পদপিষ্ট হয়ে এই দুর্ঘটনা। প্রশাসনিক একটি সূত্রের যদিও দাবি, অত্যধিক গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণেই মৃত্যু হয়েছে ওই তিন জনের। যদিও প্রশ্ন উঠছে, কারণ যা-ই হোক, এমন ভিড় যে হতে পারে, তা কি আগাম অনুমান করা যায়নি? কেন সেক্ষেত্রে ভিড় নিয়ন্ত্রণের যথাযথ ব্যবস্থা রাখা হয়নি? এমন ঘটনা ঘটলে প্রশাসন থেকে স্থানীয় কর্তা-ব্যক্তিরা দ্রুত নেমে পড়ে পরিস্থিতিসামলানোর কথা বললেও দুর্ঘটনা ঘটার আগেই কেন এমন পদক্ষেপ করা হয় না? পুরনো ঘটনা থেকেই বা কেন শিক্ষা নেওয়া হয় না— উঠছে সে প্রশ্নও।
এ দিনের ঘটনার সঙ্গে অনেকেই মিল পাচ্ছেন ২০১৯ সালের অগস্টের কচুয়ার লোকনাথ মন্দিরের ঘটনার। সে দিন প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টি থামার পরে জন্মাষ্টমীর ক্ষণ পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে এক সময়ে মন্দিরে ঢোকার প্রবল হুড়োহুড়ি শুরু হয়। যে রাস্তা দিয়ে পুণ্যার্থীরা যাচ্ছিলেন, সেটি ১৫০ মিটার লম্বা এবং ১০ হাত চওড়া ছিল। তার এক দিকে পুকুর এবং অন্য দিকে পাঁচিল। এক সময়ে পুকুরের উপরে বাঁশের তৈরি অস্থায়ী দোকানে পুণ্যার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকে। কিছুক্ষণ পরে ভিড়ের চাপে সেই সব দোকানের কয়েকটি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করেন লোকজন। তার মধ্যেই রাস্তার ধারের পাঁচিলটি ভেঙে পড়লে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। জখম হন শতাধিক। ওই ঘটনায় মন্দির চত্বরে ভিড় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন উঠেছিল। কেন ঘটনাস্থলে কোনও স্বাস্থ্য শিবির বা অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা ছিল না, সেই প্রশ্নও ওঠে। একই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে রবিবারের পানিহাটির ঘটনাও। পরবর্তী কালে ক্ষতিপূরণ এবং ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও কচুয়ার ঘটনায় এর বেশি কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ।
২০১৪ সালের অগস্টেও ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে এক মহিলার মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। তারকেশ্বর মন্দিরে যাওয়ার পথে এক জায়গায় রেলগেট পড়ে যাওয়ায় তার কাছে ভিড় বাড়তে থাকে। এক সময়ে গেট পেরিয়ে ঢুকে পড়ার হুড়োহুড়ি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, অনেকেই আহত হন। মৃত্যু হয় ওই মহিলার। পুলিশ সেই সময়ে দাবি করে, তাদের কোনও ঘোষণাই কানে তোলেননি পুণ্যার্থীরা। ২০১৭ সালে আবার ছ’জনের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছিল গঙ্গাসাগরে। মেলা শেষে মুড়িগঙ্গায় ভেসেল ধরার প্রবল ভিড় হয়েছিল। কিন্তু নদীতে জোয়ার না থাকায় বেশ কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় পুণ্যার্থীদের। এর পরে ভেসেল এলে তাতে তড়িঘড়ি ওঠার চেষ্টা করেন অনেকে। সেই সময়েই পড়ে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি।প্রশাসনের তরফে যদিও সেই সময়ে বলা হয়েছিল, গরমে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
এমন ঘটনায় মৃত্যু ঘিরে দায় এড়ানোর উদাহরণও রয়েছে প্রচুর। চলতি বছরের শুরুতেই কাটরার বৈষ্ণোদেবী মন্দিরে যাওয়ার পথে মৃত্যু হয় ১২ জনের। উত্তরাখণ্ডের চারধাম মন্দিরে গত ২৯ মে পর্যন্ত ১২৫ দিনে মৃত্যু হয়েছে ৯৯ জনের। এর আগে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজামুন্দ্রিতে পুস্করালু মেলায় মৃত্যু হয় ২৭ জনের। প্রায় সব ক্ষেত্রেই নিজেদের দায় উড়িয়ে প্রশাসন বা মন্দির কর্তৃপক্ষ দায়ী করেছেন আবহাওয়াকে। যেমন করা হচ্ছে এ দিনের গরমকে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।