বুঁদ: ক্লাসে না গিয়ে মোবাইলে ডুব। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় সে সময়ে অনলাইন ক্লাস হয়েছে। সে জন্য অভিভাবকেরা অনেকেই ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিয়েছেন স্মার্টফোন। সেই ফোনই এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেক অভিভাবকের কাছে। বিষয়টি ভোগাচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও। কারণ, মোবাইল হাতে পেয়ে ছেলেমেয়েরা অনেকেই ইদানীং অনলাইন গেমের নেশায় বুঁদ। স্কুল পালিয়েও অনেকে মোবাইলে গেম খেলছে বলে শিক্ষক-অভিভাকদের নজরে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন তাঁরা।
বনগাঁ মহকুমার বাগদার কোনিয়াড়া যাদবচন্দ্র বিদ্যাপীঠ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা স্কুল খোলার আগে গ্রামে গ্রামে অভিযান চালিয়েছিলেন। অনলাইন ক্লাসে কেন পড়ুয়ারা হাজির হচ্ছে না, তা জানার চেষ্টা করেন তাঁরা। দেখা যায়, অনলাইন ক্লাস চলাকালীন কিছু পড়ুয়া ব্যস্ত থাকছে মোবাইলে গেম খেলতে। বাওড়ের পাশে বসে দল বেঁধে চলছে খেলা। কোনও দিকে হুঁশ নেই কারও। কয়েক জনকে শিক্ষকেরা হাতেনাতে ধরেও ফেলেন।
প্রধান শিক্ষক অনুপম সর্দার বলেন, ‘‘স্কুল খোলার পরে পড়ুয়াদের উপস্থিতি কম হচ্ছে। কারণ জানতে আবারও আমরা গ্রামে অভিযান চালাই। চোখে পড়ে, স্কুলে না এসে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকে। তাদের সঙ্গে মোবাইল। গেম খেলছে অনেকে। বাড়িতে গিয়ে অভিভাবকদের সে কথা বলে এসেছি।’’ বনগাঁর গাঁড়াপোতা গার্লস হাইস্কুল কর্তৃপক্ষ নোটিস দিয়ে ছাত্রীদের জানিয়েছে, স্কুলে মোবাইল নিয়ে আসা যাবে না। প্রধান শিক্ষিকা ববি মিত্র বলেন, ‘‘ছাত্রীরা স্কুলে যাতায়াতের পথে ও টিফিনের সময়ে মোবাইলে ব্যস্ত থাকছিল। সে কারণে নোটিস দিয়ে ছাত্রীদের বলে দেওয়া হয়েছে, মোবাইল নিয়ে স্কুলে আসা যাবে না। কেউ মোবাইল নিয়ে এলে তা অফিসে জমা রাখা হচ্ছে। স্কুল ছুটির পরে তা ছাত্রীদের ফেরত দেওয়া হচ্ছে।’’ নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীরা স্কুলে এলেও পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীরা বাড়িতে অনলাইন ক্লাস করছে। ববি বলেন, ‘‘পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীদের অভিভাবকদের বলে দেওয়া হয়েছে, বাড়িতে নজর রাখতে। যাতে ছোটরা অনলাইন ক্লাস করা নামে মোবাইলে গেম না খেলে।’’
হাবড়ার প্রফুল্লনগর বিদ্যামন্দির স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, স্কুলে না এসে ছাত্রেরা মোবাইল সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। কয়েকজন মিলে মোবাইলে গল্প করে সময় কাটাচ্ছে। গেম খেলছে। এমনকী, গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে যাওয়ার সময়েও মোবাইল সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক সত্যজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘‘ছাত্রেরা অনেকে মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে। অভিভাবকেরাও অনেকে হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। আমরাও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত।’’
শনিবার স্কুলে অভিভাবকদের নিয়ে বৈঠক ডাকা হয়। অনেকেই এই সমস্যার কথা জানিয়েছেন। শুধু মোবাইলে গেম খেলাই নয়, নানা রকমের অপব্যবহার হচ্ছে মোবাইলের, এমনই জানিয়েছেন কয়েকজন অভিভাবক। ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে মোবাইল জোর করে নিয়ে নিলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে বলেও জানাচ্ছেন অনেকে। এই স্কুলে মোবাইল আনা নিষেধ। সে কারণেও অনেকে স্কুলে আসতে চাইছে না বলে জানতে পেরেছেন প্রধান শিক্ষক।
বসিরহাটের হিঙ্গলগঞ্জের কনকনগর এসডি ইন্সটিটিউশনের প্রধান শিক্ষক পুলক রায়চৌধুরী জানিয়েছেন, স্কুলে যাওয়ার নাম করে অনেক পড়ুয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় বসে গেম খেলতে ব্যস্ত থাকছে। তাদের পরিবারের লোকজন জানতেও পারছেন না। দিন কয়েক আগে এমনই গেমে আসক্ত পড়ুয়াদের বাড়িতে গিয়ে বোঝানো হয়েছে।
হাসনাবাদের দুর্গাপুর বাইলানি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সমীরকুমার মান্না বলেন, ‘‘স্কুলের অনেক পড়ুয়া অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে শুনে দুর্গাপুর গ্রামের বিভিন্ন নির্জন জায়গায় হানা দিয়েছি। পড়ুয়াদের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত দেখে অনেককে বকাবকি করা হয়েছে। কিন্তু বিশেষ লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না। অনেক পড়ুয়া এখনও অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে মাঝে মাঝে স্কুলে আসছে না বলে অভিভাবকেরা জানাচ্ছেন।’’
মোবাইলে এ হেন আসক্তি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে তো বটেই, মনোঃসংযোগেও ব্যাঘাত ঘটবে বলে মনে করেন চিকিৎসকেরা। মোবাইলে আসক্তি কমাতে খেলাধুলার উপরে জোর দেওয়ার কথা বলছেন তাঁরা। এক অভিভাবকের কথায়, ‘‘বিষয়টা ক্রমশ উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। মোবাইলের নেশা ছাড়াতে না পারলে ওরা পড়বে কী করে!’’