নিশুত রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে কখনও ভেসে আসে দক্ষিণরায়ের গর্জন। কখনও নাম না জানা পাখির ডাকে লজের ঘরে বসে শিহরিত হন পর্যটক। শহর থেকে বহু দূরে সুন্দরী, গরান, গেঁওয়ার জঙ্গলে রাতবিরেতে ঝরা পাতার খসখস শব্দ যেন অলৌকিক এক জগতের অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে। চাঁদনি রাতে মাতলা, রায়মঙ্গলের বুকে লঞ্চে ভেসে থাকার অভিজ্ঞতা যাঁর এক বার হয়েছে, নিশির ডাক পাওয়ার মতোই তিনি ফিরে ফিরে যান সুন্দরবনে।
কিন্তু পর্যটন যেখানে শিল্প, সেখানে আর পাঁচটা শিল্পের মতোই পরিকাঠামোর কিছু দাবিও আছে। যার মধ্যে অন্যতম হল নিরাপত্তা যা বার বার বিঘ্নিত হচ্ছে সুন্দরবনে। শনিবার পিয়ালিতে যা ঘটল, তা যে কোনও সময়ে সুন্দরবনে পর্যটকদের সঙ্গে ঘটা যে অসম্ভব নয়, তা মেনে নিচ্ছেন বহু পর্যটকই।
বারাসতের বাসিন্দা উত্তম সরকার বহু বার গিয়েছেন সুন্দরবনে বেড়াতে। তাঁর অভিজ্ঞতায়, “রাতে যখন লঞ্চে নদীতে থেকেছি, তখন নিরাপত্তারক্ষীদের কোনও টহলদারি চোখে পড়েনি। আবার লজের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী আছে ঠিকই, কিন্তু দুষ্কৃতী হামলার মোকাবিলার মতো কোনও পরিকাঠামোই তাদের নেই।” দেগঙ্গার জগদীশ হালদার বলেন, “খুবই প্রত্যন্ত সব এলাকা। পর্যটনের মজবুত পরিকাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি। বহু বিদেশি পর্যটকও আসেন সুন্দরবনে। সকলের নিরাপত্তার দিকটি খেয়াল রাখা খুবই জরুরি।”
কয়েক মাস আগে গাদিয়াড়ার লজে মেয়েদের আটকে রেখে দেহ ব্যবসার অভিযোগ উঠেছিল। সাধারণ পর্যটকেরা সেখানে গিয়ে বহু বার হেনস্থা হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। ছোটখাট চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা এ রাজ্যের বহু পর্যটন কেন্দ্রেই ঘটে থাকে বলে অনেকেরই অভিজ্ঞতা হয়েছে। দিঘায় বেড়াতে গিয়ে পকেটমারদের হাতে টাকা-পয়সা মোবাইল খুইয়েছেন, এমন অনেকেই আছেন। তবু জনবহুল এলাকায় নিরাপত্তা কিছুটা হলেও আছে। কিন্তু সুন্দরবনের মতো জলে-জঙ্গলে ঘেরা প্রত্যন্ত এলাকায় পর্যটকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার দাবি দীর্ঘ দিনের।
গত বছর ২২ ফেব্রুয়ারি কুলতলির ঝড়খালি মোহনার কাছে রানাঘাট থেকে আসা ৪০ জনের একটি দলের উপরে লঞ্চের উপরেই হামলা চালিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। মারধর করে টাকা-পয়সা, মোবাইল ছিনতাই করা হয়। মহিলাদের শ্লীলতাহানি করা হয় বলেও অভিযোগ উঠেছিল। কুলতলিরই কেল্লায় গত বছর শীতকালে পর্যটকদের উপরে হামলা, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল। পর্যটকদের অভিযোগ, বেশির ভাগ জায়গায় পুলিশের নজরদারি থাকেন না। কোনও দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, তা-ও জানা থাকে না পর্যটকদের। কোনও ফোন নম্বর থাকে না তাঁদের কাছে। ফলে নানা ভাবে হেনস্থা হতে হয়। কিছু দিন আগে ক্যানিং স্টেশন চত্বরে ব্যাগ খুইয়েছিলেন পর্যটক রাজেন্দ্র প্রসাদ। তিনি অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন ক্যানিং জিআরপি-র কাছে। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় সোনারপুর জিআরপি-তে। এই চলে দীর্ঘ ক্ষণ চলে টানাপড়েন। শেষমেশ, একটি সাধারণ ডায়েরি নিয়েই কর্তব্য সারে ক্যানিং জিআরপি।
ভারত-বাংলাদেশের সীমানায় জলপথে নজরদারির কথা বিএসএফের। পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অনেকে এ ব্যাপারে জানালেন, বিএসএফের নজরদারিও তেমন ভাবে চোখে পড়ে না।
পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সুন্দরবন পিপলস ওয়াটার সোসাইটির সম্পাদক অনিমেশ মণ্ডল বলেন, “বনি ক্যাম্প, কলস, বুড়ির দাবড়ির মতো কোর এরিয়া-সংলগ্ন পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে নিরাপত্তা বাড়ানো খুবই দরকার। বহু মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে আসেন। বিদেশি পর্যটকেরাও আসেন। কিন্তু পুলিশ বা বিএসএফের নজরদারি তেমন চোখে পড়ে না।” বন দফতরের নজরদারিরও অভাব আছে বলে মনে করেন তিনি। সারা বছর সম্ভব না হলেও পর্যটনের মরসুমটুকুতে যাতে কয়েক মাসের জন্য নিরাপত্তা বাড়ানো যায়, সেই আর্জি জানিয়েছেন তিনি।
নানা সময়ে সুন্দরবনে ঘুরতে আসা পর্যটকদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ট্রেনে চড়ে ক্যানিং হয়ে সুন্দরবনে আসার অভিজ্ঞতাও অনেকের বেশ খারাপ। ক্যানিং স্টেশন চত্বরে চুরি-ছিনতাই লেগেই থাকে। যাঁরা একটু রাত করে ক্যানিংয়ে পৌঁছন, তাঁরা ভাল থাকার জায়গা পান না। কিছু সস্তার হোটেল থাকলেও সেগুলিতে না আছে ভাল পরিষেবা, না আছে নিরাপত্তা। স্রেফ রাতটুকু কাটিয়ে সুন্দরবনে যেতে না পেরে ফিরতি ট্রেনে কলকাতা ফিরতে হয়, এমন অভিজ্ঞতাও আছে অনেকের।
কয়েক জন লজ ম্যানেজার দাবি করলেন, তাঁদের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী থাকেন। কোনও দুর্ঘটনা হলে সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে। তবে নিরাপত্তা আরও বাড়ানোর ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসনের তত্পর হওয়া উচিত বলেও মনে করেন তাঁরা।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা বনাধিকারিক লিপিকা রায়ের মতে, আইন-শৃঙ্খলার বিষয়টি দেখার কথা পুলিশ-প্রশাসনের। তাঁদের তরফে যে ধরনের নজরদারি চালানো সম্ভব, তা তাঁরা করে থাকেন বলেও দাবি বনাধিকারিকের। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পূর্ব) অরিজিত্ সিংহ বলেন, “পর্যটকদের উপরে যে কোনও ধরনের আক্রমণ অত্যন্ত দুঃখজনক। পুলিশ-প্রশাসন সব সময়েই নিরাপত্তার দিকটি দেখে। নিয়মিত টহলদারি চলে।”
কিন্তু বাস্তব হল, জল-জঙ্গলে রয়ালবেঙ্গল টাইগার কিংবা বিষধর সাপের থেকেও চোর-ডাকাতের ভয় ইদানীং জাঁকিয়ে বসছে দু’দিন শান্তিতে কাটানোর ইচ্ছে নিয়ে সুন্দরবনে আসা পর্যটকদের মধ্যে। পিয়ালির ঘটনা সে দিকেই আরও এক বার ইঙ্গিত করে গেল।