পুলিশের লাঠিচার্জ। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছুড়ছে জনতা।
গ্রামের বাসিন্দা এক যুবক নিখোঁজ গত মাস দেড়েক ধরে। তিনি আবার সক্রিয় তৃণমূল কর্মীও বটে। ইতিমধ্যেই ঘটনার তদন্তভার নিয়েছে সিআইডি। তারপরেও খোঁজ মেলেনি গোপালনগরের নতিডাঙার বছর বত্রিশের যুবক আমিনুর মণ্ডলের। গ্রামে এ নিয়ে উত্তেজনা ছিলই। শুক্রবার পথ অবরোধ কর্মসূচি নেন গ্রামের মানুষ। পুলিশের সঙ্গে তাঁদের খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায়। লাঠি চালায় পুলিশ। কাঁদানে গ্যাসের সেলও ফাটানো হয়। সংঘর্ষে জখম হয়েছেন তিন পুলিশ কর্মী। লাঠির ঘায়ে কয়েক জন গ্রামবাসীও চোট পেয়েছেন। পুলিশের উপরে হামলার অভিযোগে ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়। আমিনুরের খোঁজে জেলা পুলিশ ও সিআইডি যৌথ ভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যে এক জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এলাকায় উত্তেজনা থাকায় পুলিশি টহলদারি চলছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এ দিন বেলা ৩টের পর থেকে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ভিড় করতে শুরু করেন গোপালনগরের কালীবাড়ি এলাকায়। বনগাঁ-চাকদা সড়ক অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। খবর পেয়ে গাইঘাটার সিআই পার্থ সান্যাল বাহিনী নিয়ে এলাকায় পৌঁছন। বাসিন্দাদের অবরোধ তুলে নেওয়ার অনুরোধ করে পুলিশ। সিআই জানান, পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্তে গাফিলতির যে অভিযোগ তুলছেন বাসিন্দারা, সে জন্য থানায় গিয়ে স্মারকলিপি দিতে পারেন তাঁরা।
পুলিশের দাবি, কথাবার্তা শান্তিপূর্ণ ভাবেই এগোচ্ছিল। হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে থেকে ইট-পাটকেল উড়ে আসতে শুরু করে পুলিশকে লক্ষ্য করে। পুলিশও তেড়ে যায়। শুরু হয়ে যায় গোলমাল। গোপালনগর-কল্যাণপুর রাস্তার হাটখোলার কাছে গ্রামবাসীরা পূর্বপরিকল্পিত ভাবে ইট-পাটকেল, চ্যালাকাঠ জড়ো করে রেখেছিল বলে দাবি করেছে পুলিশ। গ্রামের লোকের পাল্টা দাবি, পুলিশ কোনও রকম প্ররোচনা ছাড়়াই অবরোধ তুলতে চেয়ে লাঠি চালানো শুরু করে। তার ফলেই পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে বেরিয়ে যায়। জেলা পুলিশের ডিএসপি (হেডকোর্য়ার্টার) দুর্বার বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আশপাশের কয়েকটি থানার ওসি, আইসিরাও বাহিনী নিয়ে চলে আসেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, পুলিশও পাল্টা ইট ছুড়েছে।
এ দিন গোলমাল হতে পারে বলে আশঙ্কা ছিলই। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব গ্রামবাসীদের অবরোধ না করার অনুরোধ জানিয়ে এসেছিলেন গ্রামে গিয়ে। তারপরেও অবশ্য সিদ্ধান্ত বদল করেননি স্থানীয় মানুষ। তবে বার বার এলাকায় অবরোধ হওয়ায় সমস্যায় পড়েছেন এলাকার ব্যবসায়ীরা। এ দিন গোলমালের জেরে দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যায়। গোপালনগর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক অজয় বাগ বলেন, ‘‘এ ভাবে বার বার অবরোধ হলে ব্যবসায় অসুবিধা হচ্ছে। আমরাও চাই ওই যুবকের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে সঠিক তদন্ত করে রহস্য উদ্ঘাটিত করুক পুলিশ। কিন্তু অবরোধ যেন না হয়।’’
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, আমিনুরকে শেষ দেখা গিয়েছিল গত ২১ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন নতিডাঙায় বনগাঁ উপ নির্বাচনে জয়ী তৃণমূল সাংসদ মমতা ঠাকুরের সমর্থনে মিছিল বেরিয়েছিল। আমিনুর ছিলেন যার সামনের সারিতেই। মিছিলের পরে সন্ধ্যার দিকে চার সঙ্গীর সঙ্গে দেখা গিয়েছিল ওই যুবককে। পরে একটি দোকানে বসে গল্পগুজব করতেও দেখা যায়। রাতের দিকে তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন কিনা, তা স্পষ্ট ভাবে জানাতে পারেননি আত্মীয়েরা। ভোরের দিকে এলাকার কয়েক জন চাষি আমিনুরকে খেতের কাজে যাওয়ার জন্য ডাকতে আসেন। তখন আর তাঁকে দেখা যায়নি। আমিনুর নিজেও চাষ-আবাদ করতেন। তাঁর বড় দাদা আলাদা সংসার করেছেন। ছোট ভাই কর্মসূত্রে থাকেন ভিনদেশে। বাবা-মাকে নিয়ে বাড়িতে থাকতেন অবিবাহিত যুবকটি।
তিনি হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় পরিবার-পরিজন পুলিশের দ্বারস্থ হন। গোপালনগর থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। গ্রামের লোকও এলাকা তন্ন তন্ন করে খোঁজেন। কাছেই বড়সড় একটি বাওর আছে। সেখানে জাল ফেলেও তল্লাশি চলে। কিন্তু খোঁজ মেলেনি আমিনুরের।
পুলিশ ও স্থানীয় বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস গ্রামে এসে এলাকার মানুষজনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। দ্রুত আমিনুরকে খুঁজে বের করার প্রতিশ্রুতি দেন তাঁরা। কিন্তু আমিনুরে হদিস না মেলায় গ্রামে উত্তেজনা দানা বাঁধতে থাকে। দলের কর্মী নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও কানে তোলেন বলে জানিয়েছেন বিশ্বজিৎবাবু। এরপরে ঘটনার তদন্তভার নেয় সিআইডি। তারাও কয়েক বার গ্রামে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
আমিনুরের পরিবারের লোকজনের অভিযোগ ছিল, স্থানীয় এক বাসিন্দার সঙ্গে কিছু দিন আগে খেতে জল দেওয়া নিয়ে গোলমাল বেধেছিল আমিনুরের। ওই প্রতিবেশী আমিনুরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। পুলিশ তা জানতে পেরে ওই ব্যক্তিকেও ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু সেখান থেকে কোনও সূত্র পুলিশের হাতে আসেনি।
এ দিকে, গ্রামের এক যুবক বেমালুম উধাও হয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছিল। এর আগেও গোপালনগরে পথ অবরোধ করেছেন স্থানীয় মানুষ। শুক্রবার ফের অবরোধের তোড়জোড় শুরু হয়।
আমিনুরের মা সাকিনা এ দিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘‘আমার ছেলেটার কী হল বুঝতেই পারছি না। ওকে কেউ খুন করে থাকতে পারে। কিন্তু তা হলে দেহটা অন্তত উদ্ধার করুক পুলিশ।’’
—নিজস্ব চিত্র।