মনোজ বিশ্বাসের বাড়ি। ছবি: সুজিত দুয়ারি
তিনিই নার্সিংহোমের মূল ‘চিকিৎসক’। শুধু নার্সিংহোম নয়, আরও দু’টি জায়গায় তার চেম্বার। নার্সিংহোমের বাইরে বহু চিকিৎসকের নাম। কিন্তু, তার নাম কোথাও নেই। এমনকি তার বাড়িতেও না। এলাকার কেউ কেউ জানেন সে ডাক্তার। কিন্তু কিসের ডাক্তার, কোথাকার ডিগ্রি, তা জানেন না কেউ। অশোকনগর শিশুপাচার কাণ্ডে আপাতত শ্রীঘরে এ হেন চিকিৎসক মনোজ বিশ্বাস। পুলিশ জেনেছে, তার কাজ ছিল বনানী নার্সিংহোমে গর্ভপাত। পুলিশের ধারণা, তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরোতে পারে।
বছর চল্লিশের মনোজের বাড়ি স্থানীয় এজি কলোনি এলাকায়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, মনোজ সব ধরনের রোগেরই চিকিৎসা করে। বনানী নার্সিংহোমের কাছেই মনোজের চেম্বার। সেখানে মাথা ব্যাথা, পেট ব্যথা থেকে শুরু করে রক্তে শর্করা— সব রোগের চিকিৎসা করত সে। তবে তাঁর পাড়ার এক বৃদ্ধ বললেন, ‘‘মনোজ তো গর্ভপাত করানোর ডাক্তার। আমরা কখনও ওর কাছে কখনও যাইনি।’’
অভিযোগ, গর্ভপাত করানোর জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে সেই মহিলাদের নিয়ে আসত। গর্ভপাত করানোর কাজে সে নাকি বিশেষ দক্ষতারও পরিচয় দিয়েছে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। তাকে সাহায্য করত আর এক হাতুড়ে। তার খোঁজে পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালাচ্ছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, শিশু বিক্রির কারবারের পাশাপাশি বেআইনি গর্ভপাতের আঁতুড়ঘর পরিণত হয়ে উঠেছিল অশোকনগরের বনানী নার্সিংহোমটি। সদ্যজাত শিশু কন্যা বিক্রির ঘটনার তদন্তে নেমে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য হাতে এসেছে হাবড়া থানার তদন্তকারী অফিসারদের।
শিশু বিক্রির ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসতেই নড়চড়ে বসেছে স্বাস্থ্য দফতর। জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, মাস চারেক আগে কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য দফতরে গিয়েছিলেন, নার্সিংহোমের জন্য সরকারি অনুমোদনের জন্য। তখন তাদের ট্রেড লাইসেন্স, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও দমকলের ছাড়পত্র নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল। তারা আর সে সব নথি জমা দেয়নি। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রাঘবেশ মজুমদার বলেন, ‘‘অশোকনগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালের সুপারকে বলা হয়েছে ঘটনার তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হচ্ছে।’’
এলাকার বহু মানুষ জানতেন ওই নার্সিংহোমে গর্ভপাত হয়। তেমনই একজন স্থানীয় এক ওষুধ দোকানি চন্দন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘‘আমরা জানতাম, এখানে বেআইনি গর্ভপাত হয়। কিন্তু শিশু বিক্রির কথা জানা ছিল না। নার্সিংহোমটি থেকে নিম্নমানের ওষুধ বেশি দামে বিক্রি করা হত।’’
যদিও বিভিন্ন রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা এখানে রোগী দেখেন বলে চিকিৎসকদের নাম লেখা বোর্ড লাগানো রয়েছে। তাদের মধ্যে আরজিকর হাসপাতালের এক চিকিৎসকের নামও রয়েছে। পুলিশ ও বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মানুষকে বিভ্রান্ত করতে নার্সিংহোম এই বোর্ড লাগানো হয়েছিল।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে এলাকার মানুষের চোখে ধূলো দিতে নার্সিংহোমে সাইন বোর্ড লাগিয়ে ফলাও করে লিখে, রাখা হয়েছিল, ‘‘এখানে জ্বরের সু চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। ডেঙ্গি-সহ সকল প্রকার জ্বর ও প্যাথলজিক্যাল টেস্টের ব্যবস্থা রয়েছে। সব ধরনের অপারেশন ও মাইক্রো সার্জারির ব্যবস্থা আছে। এমনকি ২৪ ঘন্টা ডাক্তারি পরিষেবাও মিলবে।’’
রবিবার অশোকনগর তিন নম্বর রেলগেট এলাকায় যশোর রোডের পাশে ওই নার্সিংহোমে গিয়ে দেখা গেল, তালা ঝুলছে। এলাকার বাসিন্দাদের প্রশ্ন, কোনওরকম অনুমোদন ছাড়া, কার সাহস ভরসায় ওই নার্সিংহোমটি চলছিল? তা হলে এর পিছনে কি বড় কোনও মাথা রয়েছে।