নিজের মূর্তির সামনে বিধায়ক জয়ন্ত নস্কর। নিজস্ব চিত্র
নিজের কয়েকখানা মূর্তি বানিয়ে রেখেছেন বিধায়ক নিজেরই গাঁটের খরচে। জানিয়েছেন, তাঁর মৃত্যুর পরে সেগুলো যেন এলাকার নানা প্রান্তে বসানো হয়। কেন এমন মৃত্যুভয়? কাকে ভয় পাচ্ছেন? সে সব নিয়ে বিশেষ মুখ খোলেন না বিধায়ক। শুধু দার্শনিকের মতো বলেন, ‘কবে কী ঘটে যায়!’
গত দশ বছর রাজ্যপাট সামলে আপাতত এমনই আছেন গোসাবার তৃণমূল বিধায়ক জয়ন্ত নস্কর। এক সময়ে ঘনিষ্ঠ বরুণ নস্কর ছেড়েছেন হাত। তাঁর দাপটে গত পঞ্চায়েত ভোটে একটি পঞ্চায়েতে কোনও আসনে দাঁত ফোটাতে পারেনি তৃণমূল। জয়ী হয়েছেন বিক্ষুব্ধ নির্দলরা। এক সময়ে রাজনৈতিক হিংসার বৃত্তের বাইরে থাকা গোসাবায় গত কয়েক বছরে বার বার রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ক্রমশ মাথা তুলছে বিজেপি। তাদের সঙ্গে সঙ্ঘাত তো আছেই, তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলের ফলেও অশান্তি ছড়িয়েছে। তাতে তিতিবিরক্ত দ্বীপভূমির শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাঁদের বক্তব্য, এত বছরেও না তো হল কংক্রিটের আয়লা বাঁধ। না হল গোসাবা-গদখালি সেতু। বরং ক্রমশ রাজনৈতিক দলাদলির জায়গা হয়ে উঠছে গোসাবা। এই আবহেই আবারও একটা ভোটের মুখোমুখি বিধায়ক জয়ন্ত নস্কর।
গোসাবা ব্লকের ৩৭২.৫ কিলোমিটার নদী বাঁধের মধ্যে মাত্র ১৬ কিলোমিটার কংক্রিটের বাঁধ তৈরি হয়েছে এ যাবত। সম্প্রতি আমপানে গোসাবা বিধানসভার রাঙাবেলিয়া, আমতলি, ছোটমোল্লাখালি এলাকায় নদীবাঁধ ভেঙে বহু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বারোমাস বাঁধ ভাঙা নিয়ে চিন্তায় থাকেন এই সব এলাককার নদীর পাড়ের মানুষজন।
একে তো কংক্রিটের বাঁধ নিয়ে দাবি মেটেনি, অন্য দিকে, ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে ভেড়ি তৈরির ফলে দুর্বল হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষমতা। অভিযোগ, শাসক দলের মদতে বিঘের পর বিঘে নদীর চর দখলের ঘটনা ঘটছে।
গত দশ বছর ধরে গোসাবায় তৃণমূলের দখলে রয়েছে গোসাবা বিধানসভা। আরএসপিকে দশ হাজারের বেশি ভোটে হারিয়ে ২০১১ সালে প্রথমবারের জন্য এই বিধানসভার জয়ী হন জয়ন্ত। এক সময়ে কংগ্রেসের দাপুটে নেতা ছিলেন। পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরেন। ২০১৬ সালেও তাঁর উপরে ভরসা রেখেছিলেন মমতা। সে বার ভোটের মার্জিন দ্বিগুণ করে তার মর্যাদা রেখেছেন জয়ন্ত। কিন্তু গত কয়েক বছরে নিজের বিধানসভায় এলাকায় দলের অন্দরের চোরা স্রোত কমাতে পারেননি। মওকা বুঝে ক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে বিজেপি।
গত পঞ্চায়েত ভোটে রাঙাবেলিয়া, সাতজেলিয়া, লাহিড়িপুর, ছোট মোল্লাখালি, কুমিরমারির মতো পঞ্চায়েতগুলিতে বিজেপি যথেষ্ট ভাল ফল করেছে। ২০১১ সালে বিজেপি মাত্র ৪০৭৪ ভোট এই কেন্দ্রে পেলেও গত কয়েক বছরে ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে তারা। ২০১৬ সালের বিধানসভার তুলনায় গত লোকসভা ভোটে এক ধাক্কায় প্রায় ৬৫ হাজার ভোট বাড়িয়েছে বিজেপি।
গোসাবা ব্লকে জয়ন্ত নস্করের ‘একনায়কতন্ত্র’ দলের অন্দরেই অনেকের নাপসন্দ। বাসন্তী বিধানসভা কেন্দ্রেও নিজের প্রভাব বাড়াতে চান বলে শোনা যায়। সেখানে নিজের ভাইকে প্রার্থী করার চেষ্টা করছেন বলে জেনেছেন তাঁর দলেরই অনেকে। তাতে ক্ষুব্ধ সতীর্থদের অনেকে।
গদখালি-গোসাবার মধ্যে সেতু না হওয়ায় দ্বীপবাসীর যোগাযোগের সমস্যা এখনও মেটেনি। দ্বীপে দ্বীপে পানীয় জলের সমস্যা এখনও আছে। উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভাবের কথা বার বারই বলছেন স্থানীয় মানুষ। তার উপরে বুলবুল ও আমপানের পরে গোসাবা ব্লকে তৃণমূলের স্বজনপোষণের জন্য ক্ষুব্ধ মানুষজন।
অতীতে গোসাবায় বামেদের দাপট থাকলেও এখন তাঁদের খুঁজে পাওয়াই দায়। ২০১১ সালে আরএসপি প্রার্থী সমরেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে ১০,৬৮২ ভোটে হারিয়ে বিধায়ক হন জয়ন্ত।
রাজ্যের প্রাক্তন সেচমন্ত্রী তথা আরএসপি নেতা সুভাষ নস্কর বলেন, ‘‘আয়লার পরে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দরবার করে ৫০৩২ কোটি টাকা এনে দিয়েছিলাম। কিন্তু এই সরকার সেই টাকার কাজ করল না। মাত্র কয়েক কিলোমিটার কংক্রিটের বাঁধ নির্মাণ হয়েছে। প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ফেরত চলে গিয়েছে। দুর্বল নদীবাঁধগুলি কংক্রিটের করলে এই এলাকার মানুষজনকে বার বার নোনা জলে ভাসতে হত না।’’
গত বিধানসভা ভোটে জয়ন্তর প্রতিদ্বন্দ্বী, বিজেপি প্রার্থী সঞ্জয় নায়েকের অভিযোগ, ‘‘শুধু নদী বাঁধ নয়, এখনও পর্যন্ত গদখালি-গোসাবা সেতুর কাজ শুরু হয়নি। গোসাবার হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি বেহাল। দ্বীপে দ্বীপে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা সরকার করেনি। এই এলাকার বিভিন্ন দ্বীপে পানীয় জলের সমস্যা রয়েছে। দু’বারের বিধায়ক সেটুকু কাজ করে উঠতে পারেননি। বরং কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা এলাকার মানুষজনকে না দিয়ে শাসকদল নিজেদের মধ্যেই ভাগাভাগি করে নিয়েছে।”
বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে জয়ন্ত এলাকায় উন্নয়নের ফিরিস্তি দেন। জানান, গত পাঁচ বছরে পানীয় জলের সমস্যা মেটাতেই সব থেকে বেশি সচেষ্ট ছিলেন। বিধানসভা এলাকার বিভিন্ন প্রান্তে কমপক্ষে সাড়ে তিনশো টিউবওয়েল বসিয়েছেন। যে যে দ্বীপে ভূগর্ভস্থ জলের সমস্যা রয়েছে, সেখানে নলবাহিত পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে সে ভাবে কংক্রিটের বাঁধ তৈরি না হলেও মাটির বাঁধই যথেষ্ট মজবুত করে গড়ে তোলা হয়েছে বলে দাবি জয়ন্তর। চওড়া বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। সে কারণে আমপানের মতো ঘূর্ণিঝড়েও বিস্তীর্ণ এলাকার বাঁধ ভেঙে গ্রাম প্লাবিত হয়নি বলে জানাচ্ছেন তিনি। জয়ন্ত বলেন, “গোসাবার এক দ্বীপের সঙ্গে আর এক দ্বীপে যোগাযোগের জন্য ইতিমধ্যেই গদখালি-গোসাবা ও পাঠানখালি-হোগলডুগুরির মধ্যে সেতু তৈরির অনুমোদন মিলেছে। এ ছাড়া গত পাঁচ বছরে প্রচুর কংক্রিটের জেটি তৈরি হয়েছে। ভাসমান জেটি ও লোহার ভেসেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পরিষেবাও পৌঁছেছে। মিটেছে লোডশেডিং, লো-ভোল্টেজের সমস্যাও।”
বহু খাল সংস্কার করে এলাকার এক ফসলি জমিকে বহু ফসলি জমিতে রূপান্তরিত করা, উন্নত ধরনের কৃষির ব্যবস্থা করা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটানো, পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য অত্যাধুনিক ব্যবস্থা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া সহ বহু কাজ এলাকার মানুষের জন্য করা হয়েছে বলে জানাচ্ছেন জয়ন্ত। এলাকার যুবকদের যাতে ভিন্ রাজ্যে কাজে যেতে না হয়, সে দিকে বিশেষ নজর দিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। অন্য দিকে গোসাবা ব্লকের সমস্ত রাস্তাই হয় কংক্রিটের, নয় তো পিচের হয়েছে। নিদেন পক্ষে ইটের রাস্তা হয়েছে কোথায় কোথাও। তবে কাঁচা রাস্তা আর এই এলাকায় নেই বলেই দাবি করেছেন বিধায়ক।