আশা: ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বীজতলা তৈরি করছেন এক চাষি। রূপমারি পঞ্চায়েত এলাকায়। নিজস্ব চিত্র
ইয়াসের পর দীর্ঘদিন জলমগ্ন ছিল সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, চাষের জমি ও পুকুর। জল নামলেও নোনা জলের প্রকোপে বিঘার পর বিঘা জমিতে চাষ করা সম্ভব হয়নি। একই পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে মাছ চাষের ক্ষেত্রেও। চাষিরা নোনা জল সহ্যকারী বীজ রোপণ করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও কোথাও বাধ সেধেছে অতিবৃষ্টি, কোথাও আবার ওই বীজেও চারা হয়নি। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখল আনন্দবাজার। আজ প্রথম কিস্তি।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তাণ্ডবে সুন্দরনের গোসাবা, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালির বিস্তীর্ণ এলাকায় নদী বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল। হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি, মিষ্টি জলের পুকুর নোনা জলে ডুবে যায়। ইয়াসের এই ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই অতিবৃষ্টির কবলে ফের দিশেহারা হয়ে পড়েন চাষিরা। পর পর জোড়া আক্রমণে কার্যত বিধ্বস্ত এলাকার মানুষ।
ইয়াসের পর রূপমারি পঞ্চায়েতের কুমিরমারি, হলদা, বাইনারা, বাঁশতলা এলাকাগুলি জলমগ্ন হয়ে পড়ে। কয়েক মাস পর কিছু জায়গা থেকে জল নেমে গেলে ধান চাষ করার চেষ্টা করেন চাষিরা। তবে রূপমারিতে নোনার কবলে পড়ে ১২০০-১৪০০ বিঘা জমিতে এবার চাষ করাই যায়নি।
বাইনারা গ্রামের বাসিন্দা দীপঙ্কর মণ্ডলের সাড়ে তিন বিঘা জমি ইয়াসের পর জলে ডুবে ছিল। জল সরে যেতে সরকারি নোনা সহনকারী ধানের বীজ পেয়ে তিনি চাষের চেষ্টা করেন। তবে তাঁর দাবি, বীজ থেকে চারা হয়নি। স্থানীয় আরও কিছু চাষি সরকারি নোনা সহনকারী ধান পেয়ে চাষ করেছেন। তাঁরা জানান, ধান গাছ এখন পর্যন্ত বেড়ে উঠলেও শেষ পর্যন্ত কী হয় সেটাই দেখার। স্থানীয় এক চাষি বলেন, ‘‘এখন বৃষ্টি বেশি হওয়ায় জমিতে জল আছে। জল যখন থাকে না তখনই নোনার দাপট দেখা দেয়। ফলে, শেষ পর্যন্ত ফলন ঘরে তুলতে পারব কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। গত বছর আমপানের পর একই কারণে ধান হয়েও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।’’
ইয়াসের পর সমস্যা বাড়িয়েছে অতিবৃষ্টি। বাইনারা গ্রামের বাসিন্দা গৌর মণ্ডল জানান, আমপানের পর তাঁর প্রায় ২ বিঘা চাষের জমিতে নদীর জল ঢোকায় চাষ হয়নি। ইয়াসে তাঁর জমিতে নতুন করে নদীর জল না ঢোকায় তিনি সরকারের দেওয়া নোনা সহনকারী ধানের বীজ ‘ধিরেন’ থেকে বীজতলা তৈরি করেন। চারা বড় হয়েছিল, তবে রোপণের আগেই প্রবল বৃষ্টিতে জলে ডুবে থেকে তা নষ্ট হয়ে যায়। তিনি ফের বীজ ফেলেন। সেটাও জলে ডুবে নষ্ট হয়ে যায়। গৌরের মতো আরও অনেক চাষি একই সমস্যায় পড়েছেন। তাঁরা জানান, লোকসানের ধাক্কা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে তাঁরা চেষ্টা করছেন সারাবছর অন্তত নিজেদের খাওয়ার মতো ধান যাতে ফলানো যায়। তাই ফের বীজতলা কিনে রোপণের কাজ শুরু করেছেন তাঁরা।
হিঙ্গলগঞ্জ ব্লক সূত্রে খবর, এখানে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হয়। এবার এখনও পর্যন্ত সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। একই চিত্র দেখা গিয়েছে সন্দেশখালি ব্লকের বিভিন্ন অঞ্চলে। প্রশাসন সূত্রে খবর, সন্দেশখালি ২ ব্লকে মোট সাড়ে আট হাজার হেক্টর জমিতে ধানের চাষ হয়। অথচ এবছর মাত্র ১৪০০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে।
হিঙ্গলগঞ্জের সহ-কৃষি অধিকর্তা মৈনাক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কৃষকরা সরকারি নিয়ম মতো ক্ষতিপূরণ পাবেন। এছাড়া চাষিদের দু’ধরনের নোনা সহনকারী ধানের বীজ দেওয়া হয়েছে। তবে এ বছরও ইয়াস এবং অতিবৃষ্টির জন্য এখনও অনেকে রোপণের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। সাধারণত জুলাই মাসের মধ্যে ধান রোপণে কাজ শেষ না হলে ধানে রোগ পোকার উপদ্রব দেখা দিতে পারে।’’
সন্দেশখালি ২ ব্লকের সহকৃষি অধিকর্তা চৌধুরী মনিরুল হক বলেন, ‘‘এই অঞ্চলে নোনা সহনকারী এবং জলে ডুবে থেকেও বেঁচে থাকবে এমন বীজ প্রয়োজন। যদিও তা গবেষণার বিষয়।’’
গোসাবা ব্লকে যে সমস্ত এলাকায় জমিতে নোনা জল ঢোকেনি সেখানে কমিউনিটি চাষের মাধ্যমে বীজতলা তৈরি করে চাষের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। চাষিদের হাতে কয়েকটি প্রজাতির নোনা সহনশীল ধানবীজ তুলে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় লবণতা ও মৃত্তিকা গবেষণা কেন্দ্রের তরফে। ওই কেন্দ্রের ক্যানিং শাখার প্রধান ধীমান বর্মণ বলেন, ‘‘নোনা সহনশীল অনেক ধানই আমাদের রয়েছে। বেশ কিছু বীজ চাষিদের দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিনের টানা অতিবৃষ্টির ফলে সেই সমস্ত বীজতলা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।” অতি বৃষ্টির জেরে বীজতলা নষ্ট হয়ে গেলেও দ্বিতীয় বারের জন্য ফের বীজতলা করে গোসাবা ব্লকের প্রায় ৭৫ শতাংশ জমিতে ধান চাষ করা সম্ভব হয়েছে বলে দাবি গোসাবা ব্লক কৃষি দফতরের। ব্লকের কৃষি আধিকারিক রিতেশ কুণ্ডু বলেন, ‘‘এবার চাষের ক্ষেত্রে নানা সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে চাষিদের। তবু তাঁরা চেষ্টা করেছেন চাষ করতে। তবে রোপণে দেরি হওয়ায় ফলন কমতে পারে।”
কৃষি বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, নোনা জল ঢুকে পড়লেও পরে অতিবৃষ্টির ফলে জমির লবণতা অনেকটাই কমে গিয়েছে। ফলে, চাষের ক্ষেত্রে নুনের প্রকোপ অতটা পড়বে না।
তবে শুধু ধান নয়, মাছ চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে নোনা জলে। কুমিরমারি-সহ রূপমারি পঞ্চায়েত বিভিন্ন গ্রামে এখনও বাড়ির পুকুরগুলো নদীর জলে ডুবে আছে। ফলে মাছ চাষ করা যাচ্ছে না। শুধু তাই না রূপমারি, মামুদপুর এলাকায় লক্ষ লক্ষ টাকার চিংড়ি চাষের ক্ষতি হয়েছে।
এই বিষয়ে হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের মৎস্য সম্প্রসারণ আধিকারিক সৈকত দাস বলেন, ‘‘ব্লক জুড়ে সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে মাছ চাষের ক্ষতি হয়েছে। যার অর্থমূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা।’’ ব্লক মৎস্য সম্প্রসারণ আধিকারিক সুমিত সরকার বলেন, ‘‘সব ধরনের মাছ চাষ মিলিয়ে মোট ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে মাছ চাষের ক্ষতি হয়েছে। দুয়ারে ত্রাণ প্রকল্পে বিভিন্ন সাহায্য করা হয়েছে।’’