ভাঙড় থানা। —ফাইল চিত্র।
লোকসভা ভোটের প্রচার চলছে জোরকদমে। তবে ক্যানিং পূর্ব বিধানসভায় সে ভাবে প্রচারে দেখা যাচ্ছে না বিরোধী প্রার্থীদের। স্থানীয় সূত্রের খবর, তৃণমূলের দাপটে এখানে বিরোধীদের সংগঠন একেবারে তলানিতে। সেই দুর্বল সংগঠনই ভোটের আগে এই কেন্দ্রে ভাবাচ্ছে বিরোধী দলগুলিকে। তাদের দাবি, এলাকায় ‘আইনের শাসন’ নেই।
ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা বর্তমানে তৃণমূলের ‘দুর্গ’ হিসেবেই পরিচিত। গত বিধানসভায় তৃণমূলের সওকাত মোল্লা এখান থেকে ৫৫ হাজারেরও বেশি ভোটে জয়ী হন। তবে একটা সময়ে এই এলাকা বামেদের গড় হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০১১ সালে রাজ্য জুড়ে বাম-বিরোধী হাওয়াতেও এখানে জিতেছিলেন সিপিএমের রেজ্জাক মোল্লা। পরে ২০১৬ সাল থেকে শুরু হয় তৃণমূলের দাপট।
১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা সিপিএমের দখলে ছিল। সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন মন্ত্রী রেজ্জাকই টানা জিতে এসেছেন এখানে। এক সময়ে রেজ্জাকের ‘ডান হাত’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন সওকাত। ২০১১ সালে ক্যানিং ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সওকাতকে সিপিএম থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপরে পঞ্চায়েত সমিতির ২২ জন সদস্যের মধ্যে ১৯ জনকে নিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন তিনি। পরবর্তী কালে সিপিএমের পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের সদস্যেরা তৃণমূলে যোগ দেন।
এরপর থেকে রেজ্জাকের প্রভাব কমতে থাকে, শুরু হয় ‘সওকাত-জমানা।’ এরই মধ্যে ২০১২ সালে নিজের বাড়িতে ঘুমের মধ্যে জানলা দিয়ে ছোড়া গুলিতে খুন হন তৎকালীন ক্যানিং ২ ব্লক তৃণমূল সভাপতি মানিক পাইক। ওই ঘটনায় মানিক পাইকের বিরোধী গোষ্ঠীর তৃণমূল নেতা নজরুল মোল্লা, হাসান মোল্লা, আশরাফ মোল্লাদের নাম জড়ায়। দীর্ঘ দিন তাঁরা জেলে ছিলেন। ছাড়া পাওয়ার পরে ওই নেতারা ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের আগে আইএসএফে যোগ দেন।
এ দিকে, ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে ক্যানিং পূর্ব থেকে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হন সওকাত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভরসা জেতার পাশাপাশি পরবর্তী সময়ে তিনি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন বলে দলের অন্দরে খবর। জেলার যুব তৃণমূলের সভাপতি করা হয় তাঁকে। পরে রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক হন। পাশাপাশি, তাঁকে সাতগাছিয়া ও ভাঙড় বিধানসভার পর্যবেক্ষক হিসাবেও দায়িত্ব দেওয়া হয়।
স্থানীয় সূত্রের খবর, এলাকায় বিরোধীদের মাথা তুলতে দেননি সওকাত। তেমনই প্রশ্রয় দেননি গোষ্ঠীকোন্দলকে। পাশাপাশি, এলাকার উন্নয়নেও নজর দিয়েছেন।বিরোধীদের অবশ্য অভিযোগ, কিছু কাজ হলেও এলাকায় এখনও অনুন্নয়নের ছাপ প্রকট। এলাকায় কর্মসংস্থান না থাকায় বহু শ্রমিক ভিন্ রাজ্যে কাজে যাচ্ছেন। এলাকায় আইনের শাসন নেই বলে বার বার অভিযোগ করছেন বিরোধীরা।
জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রের আইএসএফ প্রার্থী মেঘনাথ হালদার বলেন, “ক্যানিং পূর্ব বিধানসভায় এলাকায় আমাদের দলীয় কর্মীদের মিথ্যা খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে ঢোকানো হয়েছিল। ফলে ওই এলাকায় আমাদের নির্বাচনী প্রচার জোরদার করা যায়নি।’’ তাঁর কটাক্ষ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন যদি হত, তা হলে, মা-বোনেদের গৃহসহায়িকার কাজ করতে এখান থেকে কলকাতায় যেতে হত না!মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে খুনোখুনির রাজনীতি বন্ধ করতে হবে বলে তাঁর দাবি।
জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রের আরএসপি প্রার্থী সমরেন্দ্রনাথ মণ্ডল বলেন, “এখনও ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা এলাকায় আমরা নির্বাচনী প্রচার শুরু করতে পারিনি। ওই এলাকায় আইনের শাসন নেই। ভোট লুট করে তৃণমূল ক্ষমতায় রয়েছে। মিথ্যাচার, ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই জারি থাকবে। শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থান নেই। বাধ্য হয়ে তাঁদের পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে।”
জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী অশোক কান্ডারীর কথায়, “আমরা ওই এলাকায় মানুষের কাছে ভোট চাইতে যাব। কিন্তু ওরা (তৃণমূল) মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে দেয় না। আমরা যদি ভোট লুট বন্ধ করতে পারি, তা হলে ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা এলাকায় জিতব। ওই এলাকায় আমাদের সংগঠন দুর্বল বলব না, কিন্তু আমাদের মণ্ডল সভাপতিদের এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হয় না। ওরা রিগিং করে ক্ষমতায় টিকে আছে।”
সব অভিযোগই অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছেন সওকাত। তিনি বলেন, “এলাকায় অনেক উন্নয়ন করেছি। তা সত্ত্বেও কিছু সমস্যা রয়েছে। বিরোধীরা অনেক কথাই বলবে। বাম আমলে এই এলাকায় কী উন্নয়ন হয়েছে, আর এখন কী উন্নয়ন হয়েছে— তা এলাকার মানুষ ভাল করে জানেন। বিরোধীদের বলব, অন্যান্য জায়গায় বুথে চার জন করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান থাকলে, এখানে ১২ জন করে দেওয়া হোক। প্রতি বাড়িতে দু’জন করে কেন্দ্রীয় বাহিনী দেওয়া হোক। তারপরেও উন্নয়নই শেষ কথা বলবে।”