গতি: দ্রুত কাজ এগোচ্ছে প্রকল্পের। ছবি: সুজিত দুয়ারি
অশোকনগরে পাইলট প্রকল্পে তেল ও গ্যাসের ভান্ডারের সন্ধান পেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ওএনজিসি। বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় তেলমন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান জানিয়েছেন, নমুনা পরীক্ষা চলছে সেগুলির। সেই সঙ্গে তাঁর বার্তা, সব কিছু ঠিকঠাক চললে শীঘ্রই সেই তেল বাণিজ্যিক ভাবে উত্তোলন করা যাবে বলে আশা।
মন্ত্রীর ঘোষণার পরে এখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন অশোকনগরের বাসিন্দারা। তাঁরা মনে করছেন, এর ফলে রাজ্যের শিল্প মানচিত্রে ফের একবার অশোকনগরের নাম যুক্ত হবে। কর্মসংস্থান হবে। এলাকার আর্থিক মানচিত্র পাল্টে যাবে।
অতীতে একটা সময়ে রাজ্যের শিল্প মানচিত্রে অশোকনগরের নাম ছিল উজ্জ্বল। বেশ কিছু কল কারখানা এখানে স্বাধীনতার পরে গড়ে উঠেছিল। অনেক উদ্বাস্তু মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা সেখানে কাজ করতেন। পরবর্তী সময়ে সে সব কল-কারখানা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। কিছু বন্ধের মুখে। যা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এখানে নতুন কল-কারখানা গড়েও ওঠেনি। শোলার মুকুট তৈরি বা গয়নার বাক্স তৈরির মতো কয়েকটি ক্ষুদ্র শিল্প টিমটিম করে টিঁকে আছে।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, অতীতে অশোকনগরে চুন তৈরির কারখানা ‘রাধা কেমিক্যালস’ ছিল। অনেক বছর আগে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাপড় বোনা, কাঠের আসবাবপত্র, সিল্কের শাড়ি তৈরির কারখানা ‘রিহ্যাবিলিটেশন ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন’ বা আরআইসি বছর একুশ বছর আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কয়েকশো উদ্বাস্তু মহিলা এখানে কাজ করতেন। বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে তৈরি কল্যাণী স্পিনিং মিলসে অনেক দিন হল উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাঁতের কারখানা ছিল, তা-ও বন্ধ।
স্বাভাবিক ভাবেই গ্যাস ও তেল উত্তোলন শিল্পের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় উচ্ছ্বসিত এখানকার মানুষ।
কয়েক বছর আগে অশোকনগর থানা এলাকায় হাবড়া-নৈহাটি সড়কের কাছে বাইগাছি মৌজায় কৃষি ও জলাজমিতে প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধানে খননের কাজ শুরু করেছিল ওএনজিসি। সূত্রের খবর, সব ঠিকঠাক চললে চলতি অর্থবর্ষ শেষের আগেই অশোকনগরে বাণিজ্যিক উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
হাবড়া-নৈহাটি সড়ক থেকে বাঁ দিকে ১ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছনো গেল প্রকল্প এলাকায়। ভিতরে ঢোকা নিষেধ। সরকারি গাড়ি ঘনঘন এলাকায় যাতায়াত করছে। মাটি-ইটের রাস্তায় পাথর ফেলে দ্রুত পাকা করা হচ্ছে। প্রকল্পের ভিতরে থাকা এক কর্মী জানালেন, শীঘ্রই তেলমন্ত্রীর এখানে আসার কথা। ২৪ নভেম্বরের মধ্যে ১ কিলোমিটার রাস্তা তৈরির কাজ শেষ করা হবে। প্রকল্পের কাজের জন্য পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডে কর্মীদের জন্য ঘর তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকার কাছে শ্রমলক্ষ্মী কলোনি এলাকায় রাস্তার পাশে বেশ কিছু দোকানপাট বসে গিয়েছে। মাস দু’য়েক আগে খাবারের দোকান করেছেন দিনমজুর মহাদেব দাস। তিনি বলেন, ‘‘এখানে তেল-গ্যাস তোলা শুরু হলে এলাকার চেহারাই বদলে যাবে। প্রচুর মানুষ যাতায়াত করবেন। সে সব ভেবে খাবারের দোকান করেছি।’’ চায়ের দোকানি সুধাংশু সূত্রধর বলেন, ‘‘উন্নয়ন হবে। ব্যবসা বাড়বে। ইতিমধ্যেই বিক্রিবাটা বেড়ে গিয়েছে।’’ প্রকল্পটি চার একর জমির উপরে। আরও ১২ একর জমি ওএনজিসি কর্তৃপক্ষ রাজ্যের কাছে চেয়েছেন। চার একর জমি ছিল খাস, উদ্বাস্তু ও পুনর্বাসন দফতরের। সেখানে অনেকে চাষবাস করতেন। অনুপকুমার মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘‘প্রকল্প এলাকায় আমার মামার পৌনে ৩ বিঘে জমি ছিল। আমরা চাষবাস করতাম। ওএনজিসি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন, আমাদের কর্মসংস্থান ও আর্থিক সাহায্যের সুযোগ করে দিন।’’
অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, ওএনজিসি কর্তৃপক্ষ ১২ একর জমি চেয়েছিল প্রশাসনের কাছ থেকে। তার নো-অবজেকশন দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি এখন নবান্নে আছে। প্রকল্পের এলাকায় যাঁরা চাষবাস করতেন, তাঁদের জমির নথিপত্র দেখাতে বলা হয়েছিল। তাঁরা দেখাতে পারেননি। পুরপ্রশাসক প্রবোধ সরকার বলেন, ‘‘এখানে তেল-গ্যাস উত্তোলন শুরু হলে অনুসারী শিল্প গড়ে উঠবে। রাজ্য সরকারও এখান থেকে আর্থিক লাভবান হবে। কর্মসংস্থান বাড়বে।’’ বিধায়ক ধীমান রায় বলেন, ‘‘একটা সময়ে জমি পেতে ওএনজিসি কর্তৃপক্ষের অসুবিধা হচ্ছিল। আমরা সহযোগিতা করেছিলাম। তারপরে আর ওঁরা যোগাযোগ রাখেননি। তবে শিল্প গড়ে উঠলে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটবে। আমরা সব রকমের সহযোগিতা করব।’’ প্রাক্তন বিধায়ক, সিপিএমের সত্যসেবী করের কথায়, ‘‘এখানে তেল রিফাইন করা না গেলেও ফিলিং স্টেশন করা হোক। আর প্রকল্পটি যেন ওএনজিসি কর্তৃপক্ষের হাতেই থাকে। তা হলে অশোকনগর এবং আশপাশের অর্থনৈতিক মানচিত্র পাল্টে যাবে।’’ বিজেপি নেতা স্বপনকুমার দে বলেন, ‘‘পৃথিবীর মানচিত্রে অশোকনগরের নাম উঠে এল। ইতিমধ্যেই এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতি হতে শুরু করেছে।’’