অবিলম্বে শিক্ষক নিয়োগ না হলে সার্বিক ভাবে সামাজিক অবক্ষয় বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা বহু প্রবীণ শিক্ষকের। প্রতীকী ছবি।
পড়াশোনা তো লাটে উঠছেই, ছেলেমেয়েদের স্কুলমুখী করতে যে সব প্রকল্প আছে সরকারের, সে সবের রূপায়ণও কতটা সম্ভব হচ্ছে, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। অবিলম্বে শিক্ষক নিয়োগ না হলে সার্বিক ভাবে সামাজিক অবক্ষয় বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা বহু প্রবীণ শিক্ষকের।
গত কয়েক বছর ধরে সরকারি নির্দেশ মতোই শিক্ষক-শিক্ষিকারা ছাত্রছাত্রীদের পাঠদানের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজেও যুক্ত থাকেন। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, নাবালিকা ছাত্রীকে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা রুখতে সচেতনতা শিবির, স্কুলছুট রুখতে উদ্যোগ, পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচি নিতে হয় তাঁদের। প্রতি বছর বিভিন্ন স্কুলের পক্ষ থেকে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি করা হয়। বিশেষ করে ম্যানগ্রোভ দিবসে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় গাছ লাগানো হয়। এই ধরনের কর্মসূচিতে ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বড় ভূমিকা থাকে। প্লাস্টিক বর্জন, ধূমপান বন্ধ-সহ কর্মসূচি সম্পর্কে পড়ুয়াদের সচেতন করতেও শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলির অন্যতম প্রধান সমস্যা, নাবালিকা বিয়ে ও নারীপাচার। স্কুলে পড়াকালীন কোনও ছাত্রীর বিয়ের ঠিক হয়েছে বলে জানতে পারলে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকেরাই উদ্যোগী হয়ে পরিবারকে বোঝান। নেপথ্যে থাকে কন্যাশ্রী দলের মেয়েরা। এ ভাবে বহু নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। প্রয়োজনে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিয়ে আটকাতে পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। উল্টো চিত্র দেখা গিয়েছিল করোনা পরিস্থিতিতে। সে সময়ে প্রায় দু’বছর স্কুল বন্ধ থাকায় বহু নাবালিকার বিয়ে হয়ে যায়।
কোনও পড়ুয়া স্কুলছুট হয়ে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করেন শিক্ষকেরা। এ ছাড়া, শিক্ষকদের দায়িত্বে রয়েছে ‘সামার প্রজেক্ট’। শিক্ষা দফতরের নির্দেশে এর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের খোঁজ নেওয়া, তাদের বাবা-মায়েরা কী ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত, আয় কত— এ সমস্ত তথ্য শিক্ষা দফতরে নিয়মিত পাঠান শিক্ষকেরা।
গত কয়েক বছরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বহু স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা নিদারুণ ভাবে কমেছে। বিশেষত, সরকারি পোর্টালের মাধ্যমে বদলির আবেদনের পদ্ধতি শুরু হওয়ায়বহু স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা তলানিতে পৌঁছেছে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে এক সময়ে পোর্টাল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে বহু স্কুলে এখন অনেক বিষয়ে কোনও শিক্ষকই নেই। এই পরিস্থিতিতে গুটিকয় শিক্ষক-শিক্ষিকা ক্লাস নেবেন, নাকি ছেলেমেয়েদের নিয়ে সামাজিক প্রকল্প চালাবেন— সমস্যা সব দিকেই। শিক্ষকের ঘাটতি থাকায় এক জন শিক্ষককে একাধিক ক্লাস করানোর দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। ফলে সামাজিক প্রকল্প চালানোর জন্য সময় হাতে থাকছে না। এক অভিভাবকের কথায়, ‘‘আগে পড়াশোনার বাইরেও ছেলেমেয়েদের নিয়ে কত অনুষ্ঠান হত স্কুলে। কত কিছু শিখতে পারত ওরা। ইদানীং তো দেখি অনেক অনুষ্ঠান হয় না বা হলেও দায়সারা ভাবে হয়!’’
শিক্ষকের অভাবে গ্রামাঞ্চলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা ক্রমশ কমছে। বহু স্কুলেই উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞানের শিক্ষক নেই। পড়ুয়াদের ইচ্ছে থাকলেও বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পারে না অনেকে। একই কারণে এলাকায় বিজ্ঞানে স্নাতক ছেলেমেয়ের সংখ্যাও কমছে।
মন্দিরবাজারে কাঁদিপুকুর নস্কর হাইস্কুলের শিক্ষক দীপ্তিময় মণ্ডল বলেন, ‘‘গণিত ও বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক দীর্ঘ দিন নেই। কোনও আংশিক সময়ের শিক্ষক রাখারও উপায় নেই। কারণ, এই এলাকায় বিজ্ঞানে স্নাতক যুবক-যুবতী মেলে না।’’ সামাজিক প্রকল্প চালাতেও তাঁরা নাজেহাল হচ্ছেন বলে জানালেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। রায়দিঘির খাঁড়াপাড়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মিলন সেন বলেন, ‘‘শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাবে পড়াশোনার ক্ষতি তো হচ্ছেই, পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প চালাতেও সমস্যা হচ্ছে।’’
গোটা বিষয় নিয়ে রাজ্যের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকার সংগঠনের সম্পাদক চন্দনকুমার মাইতি বলেন, ‘‘স্কুলে সামাজিক প্রকল্পের কাজ কঠিন হয়ে পড়েছে। শিক্ষকের অভাবে পড়াশোনার ক্ষতি তো হচ্ছেই, ছেলেমেয়েদের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরি করার কাজেও প্রভাব পড়ছে। এটা আখেরে সমাজেরই ক্ষতি করছে। অবিলম্বে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ করে স্কুলে স্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করা দরকার।’’