পুলিশি পাহারায় বুথের পথে বড়মা। শুক্রবার। ছবি: দেবাশিস রায়।
নীল ডুরে সাদা ট্যাক্সি থেকে মধ্য-নব্বইয়ের বড়মাকে ধরে ধরে নামানোর সময় ঠাকুর বাড়ির অলিন্দে নিভৃত হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।
যে হাসিতে স্পষ্ট পড়া যাচ্ছিল‘মেরে পাস মা হ্যায়!’
শুক্রবার, বনগাঁ উপনির্বাচনের সকালে শাসক দলের প্রার্থী মমতাবালা ঠাকুরের প্রাপ্তি বলতে এটুকুই।
বাকিটা আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাওয়া ঠাকুরবাড়ির চেনা চাপানউতোর-- তৃণমূলের ‘কেল্লাফতে’ হাসি, বিজেপি-র আস্ফালন। আর মতুয়া ভোট ঢলে রয়েছে তাদের দিকেই, দাবি করে পারস্পরিক আকচাআকচি।
এ দিন কাকভোরে ওই ট্যাক্সি চড়ে মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা বীণাপাণিদেবী তামাম গাইঘাটা যাঁকে বড়মা বলেই চেনে খান তিনেক উর্দিধারীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কোথায়?
তৃণমূল প্রার্থী মমতা ঠাকুর বলছেন, “এ দিক ও দিক ঘুরতে গিয়েছিলেন বোধহয়! রোজই তো বেরোতে চান। এতে ওঁর মন ভাল থাকে।” আর তৃণমূলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলছেন, “মঞ্জুল ওঁকে জোর করে ভোট দেওয়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাই বড়মা দু’জন মহিলার সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।” খাকি উর্দি সেই দুই মহিলার সঙ্গে প্রাতর্ভ্রমণ অন্তে, স্থানীয় আরপি মহাবিদ্যালয়ে নিজের ভোট দিয়ে বড়মা অবশ্য ট্যাক্সি চড়েই ফিরে এসেছেন নিজের ঘরে।
উপনির্বাচনের সাত সকালেই তৃণমূল যে এ ভাবে তাঁর মাকে ‘হাইজ্যাক’ করতে পারে, ভাবতে পারেননি সদ্য দলত্যাগী প্রাক্তন মন্ত্রী, বড়মার ছোট ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ সপুত্র বড়মার ঘরে পা দিয়েই তিনি বিলক্ষণ বুঝেছিলেন, কোথাও একটা গোলমাল হয়ে গিয়েছে। মাকে দেখতে না পেয়ে উত্তেজিত মঞ্জুল ঠাকুরবাড়ি
জুড়ে তোলপাড় শুরু করে দেন, “দেখছেন, তৃণমূলের গুন্ডামিটা, দেখছেন! ওরাই মাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। একেবারে হাইজ্যাক। মতুয়ারা এর প্রতিশোধ নেবে।” পাশ থেকে কিছু একটা বলতে গেলেন তাঁর পুত্র,বিজেপি প্রার্থী সুব্রত। থামিয়ে দিলেন মঞ্জুল, “মাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমিও তো মন্ত্রী ছিলাম। ক্ষমতায় ছিলাম। তখন তো এ সব করিনি!” সুব্রত যোগ করলেন, “ওঁর যদি কিছু হয়ে যায়, তা হলে তার দায়িত্ব তৃণমূলের গুন্ডারা নেবে তো!”
ততক্ষণে বড়মা অবশ্য পুলিশি ঘেরাটোপে ট্যাক্সি চড়ে পৌঁছে গিয়েছেন ঠাকুরনগরের চিকলপাড়ায়, তৃণমূল নেতা ধ্যানেশনারায়ণ গুহর বাড়িতে। গেটের বাইরে জনা কয়েক পুলিশ। রয়েছেন বেশ ক’জন ভক্ত মতুয়া। সেখান থেকেই আরপি মহাবিদ্যালয়। ভোট দেওয়া হয়ে গেলে বুথের বাইরে ধ্যানেশের চওড়া হাসি। জ্যোতিপ্রিয়কে ফোনে জানাচ্ছেন, “কাজ হয়ে গিয়েছে দাদা।”
শরীর ভাল নেই। সদ্য নার্সিংহোম ঘুরে এসেছেন। বিশেষ কথা-টথাও বলেন না আজকাল। তবু বড়মাকে প্রশ্ন করা গেল, “আপনাকে জোর করে তুলে আনল নাকি?”
--কই না তো!
ভোট দিলেন?
--হ্যা।
‘প্রাতর্ভ্রমণ’ শেষ। ট্যাক্সি রওনা হয়ে গেল ঠাকুরবাড়ির দিকে।
সেখানে তখন উঠোন জুড়ে পায়চারি করছেন সুব্রত। বলছেন, “যে-ই তাঁকে (বড়মা) তুলে নিয়ে যাক, উনি কী আর আপত্তি করার মতো অবস্থায় আছেন?”
সাড়ে আটটা নাগাদ ট্যাক্সি ফিরতেই ঠাকুমাকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে এলেন তিনি। ফলের রস খাইয়ে মুছিয়ে দিলেন মুখ। প্রণাম করে রওনা দিলেন ভোট কেন্দ্রের দিকে।
ঠাকুরবাড়ির কোণার ঘরে বন্ধ হল দরজা। ‘ভাগের মা’ এ বার নিদ্রা যাবেন।