এলাকার ভোল বদলে গিয়েছে ঝাঁ চকচকে রাস্তার সৌজন্যে

খুন-ডাকাতি-বোমাবাজি-গুলি— শব্দগুলো এক সময়ে লোকের মুখে মুখে ফিরত গোপালনগরে। ‘দুষ্কৃতীদের স্বর্গরাজ্য’ বললেও কম বলা হতো গোটা এলাকাকে। দুষ্কৃতীদের এলাকা দখলের লড়াইকে কেন্দ্র করে কত যে রক্ত ঝরেছে এখানে, তার ইয়ত্তা নেই।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

গোপালনগর শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৫ ০০:৫২
Share:

নতুন এই রাস্তা এক দিকে যেমন জনজীবনে গতি এনেছে, পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষেও এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজটা মসৃণ হয়েছে।

খুন-ডাকাতি-বোমাবাজি-গুলি— শব্দগুলো এক সময়ে লোকের মুখে মুখে ফিরত গোপালনগরে। ‘দুষ্কৃতীদের স্বর্গরাজ্য’ বললেও কম বলা হতো গোটা এলাকাকে। দুষ্কৃতীদের এলাকা দখলের লড়াইকে কেন্দ্র করে কত যে রক্ত ঝরেছে এখানে, তার ইয়ত্তা নেই। কত রাতে বোমা-গুলির আওয়াজে ঘুম ভেঙেছে মানুষের। তবে সে দিন বদলেছে। দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য এখন অনেকটাই ফিকে গোপালনগরে। কমেছে মোটর বাইক ছিনতাই, গরু পাচারের রমরমাও।

Advertisement

বালিয়াডাঙা গ্রামের রাস্তায় রাস্তা তৈরির জন্য নতুন ইট পড়েছে। রবিবার সেখানে দেখা হল এক প্রবীণ গ্রামবাসীর সঙ্গে। পুরনো দিনের কথা উঠতেই এখনও নিজের নাম জানাতে চাইলেন না। বললেন, ‘‘দিনের পর দিন রক্ত দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখন আর সে সব কথা মনেও করতে চাই না।’’

বাসিন্দারা জানালেন, বালিয়াডাঙা, নতিডাঙা, আলাকালীপুর, শুভরত্নপুর, সুন্দরপুর মোড়, মোল্লাহাটি, চামটা, সাতবেড়িয়ার মতো কিছু গ্রামে ছিল দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য। গোপালনগরের একাংশ নদিয়া সীমান্ত হওয়ায় দুষ্কৃতীরা অপরাধ করে নদিয়ার দিকে পালিয়ে যেত। তাদের ধরতে হিমশিম খেতে হতো পুলিশকেও।

Advertisement

কী ভাবে বদলাল পরিস্থিতি?

গোপালনগর আগে বনগাঁ থানার অধীনে ছিল। এলাকার আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির জন্য ১৯৮৯ সালে গোপালনগরে আলাদা একটি থানা হয়। প্রথমে বনগাঁ-চাকদহ সড়কের পাশে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থানা চলত। পরে থানার আলাদা নিজস্ব ভবন তৈরি হয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযানে গতি আসে। শুরু হয় ধরপাকড়। কমতে থাকে দুষ্কৃতীদের রমরমা। পুরনো দাগি কয়েক জন দুষ্কৃতী মারাও যায়। এক সময়ে বনজঙ্গলে ঘেরা এলাকায় পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষেও কড়া পদক্ষেপ নেওয়াটা সহজ ছিল না বলে মনে করেন এখানকার মানুষ। তবে পথঘাটের উন্নতি সেই কাজটা সহজ করেছে। এলাকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশকেও অসামাজিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেখেছেন স্থানীয় মানুষ। ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটে জয়ী হয়ে স্থানীয় বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাসের নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা বালিয়াডাঙা গ্রাম থেকে প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেন। সব মিলিয়ে বদলাতে থাকে এলাকার আতঙ্কের পরিবেশ।

বিদ্যুতের সাবস্টেশন মানুষের বড় বল-ভরসা।

গোপালনগরের প্রাণকেন্দ্র হল গোপালনগর বাজার। প্রতিদিন বহু লক্ষ টাকার কেনাবেচা চলে এখানে। তৈরি হয়েছে বড় বড় বাড়ি, সিনেমা হল, ব্যাঙ্ক, এটিএম, রেঁস্তোরা। জমির দামও বেড়েছে হু হু করে। এখন গোপালবাজার এলাকায় এক শতক জমির মূল্য ৭ লক্ষ টাকা। একটু ভিতরের এলাকায় ওই পরিমাণ জমির দাম দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ লক্ষ টাকা। এক সময়ে যা বিকোত কার্যত জলের দরে, জানাচ্ছেন এলাকার প্রবীণ মানুষজন। তাঁদের অনেকেরই মতে, সবই সম্ভব হয়েছে পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য। গোপালনগর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক অজয় বাগ বলেন, ‘‘কয়েক বছর আগে নতুন করে বনগাঁ-চাকদহ সড়কটি তৈরি হওয়ার পর থেকেই ব্যবসায় গতি এসেছে। মানুষ বনগাঁ বাজারে যাওয়ার আগে একবার গোপালনগর বাজারে ঘুরে যান। পুলিশের সহযোগিতায় বাজার এলাকায় শান্তি ফিরেছে।’’

কথা হচ্ছিল স্থানীয় কবি ও স্কুল শিক্ষক সমরেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বললেন, ‘‘পনেরো বছর আগে যদি কেউ এখানে ঘুরে গিয়ে থাকেন, এখন এলে আর চিনতেই পারবেন না। উন্নতি হয়েছে চোখে পড়ার মতো। যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বিস্তর।’’ গোপালনগরের উপর দিয়ে গিয়েছে বনগাঁ-চাকদহ সড়ক। ষাটের দশকেও ইট-সুরকির সরু রাস্তা ছিল সেটি। কবি তপন পালিত জানালেন, সে সময়ে রাস্তায় বা এলাকায় কোনও আলো ছিল না। দু’টি মাত্র বাস চলত। যা ‘কুণ্ডুদের বাস’ নামেই পরিচিত ছিল। সন্ধ্যার পরে মানুষ মূলত বনগাঁ থেকে এখান পর্যন্ত অন্ধকারে হেঁটেই যাতায়াত করতেন। অনেক পরে পাকা রাস্তা হলেও তা খুবই সরু ছিল।

২০১০ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের আর্থিক ঋণে ঝাঁ চকচকে বনগাঁ-চাকদহ সড়কটি নতুন করে তৈরি হয়। তারপরেই মানুষের জীবনযাত্রায় গতি আসে।

এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বহু দি‌ন আগে এলেও ২০০৩ সালের আগে পর্যন্ত ব্যাপক লোডশেডিং দেখা যেত। অবস্থাটা বদলাতে শুরু করে চালকি এলাকায় ২০০৩ সালে ১৩২-১৩২ কেভি সাবস্টেশন তৈরির পর থেকে। বনগাঁর তৎকালীন বিধায়ক সিপিএমের পঙ্কজ ঘোষ ওই সাবস্টেশন তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এখানে বহু কুটির শিল্পের কারখানাও রয়েছে।

এখানকার মানুষের মূলত এসেছেন অধুনা বাংলাদেশ থেকে। অতীতে এলাকায় পাকা বাড়ি খুঁজে পাওয়া যেত না। এখন সে দিন নেই। বহু মানুষের হাতে টাকার জোগানও বেড়েছে। বেড়েছে ক্রয় ক্ষমতা।

সব মিলিয়ে এলাকা ভোল বদলেছে ঠিকই, তবে নাগরিক জীবনে কিছু সমস্যা এখনও ভোগায় মানুষকে। কী সেই সমস্যা?

(চলবে)

ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement