TMC

বাম বিধায়ক, তবু এলাকার নিয়ন্ত্রণ তৃণমূলেরই হাতে

গত পাঁচ বছর ধরে রাজনীতির লড়াইয়ের শেষে কী পেলেন মানুষ? প্রতিশ্রুতি পালনে কতটা সাফল্য এল বিধায়কের ঝুলিতে? কী বলছে জনতা? বিরোধীদেরই বা বক্তব্য কী— এ সবেরই খতিয়ান জানাবে রিপোর্ট কার্ড।

Advertisement

সমীরণ দাস 

কুলতলি শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২১ ০৭:৪৯
Share:

কুলতলির কৈখালির বেহাল জেটি ঘাট। —নিজস্ব চিত্র

রাজ্য জুড়ে বিপর্যয়ের মধ্যেও গতবার কুলতলি আসনটি দখলে রেখেছিল সিপিএম। যাদবপুর ছাড়া দক্ষিণ ২৪ পরগনার একমাত্র এই কেন্দ্রেই উড়েছিল লাল পতাকা। কিন্তু গত পাঁচ বছরে তৃণমূলের দাপটে এলাকায় বামেরা ক্রমশ ফিকে হয়েছে। বিধায়ক সিপিএমের হলেও এলাকার রাশ ক্রমশ চলে গিয়েছে তৃণমূলের হাতেই। আর রাজনৈতিক টানাপড়েনে উন্নয়ন শুরু থেকেই থেকে গিয়েছে পিছনের সারিতে।
সুন্দরবনের অন্যতম প্রবেশদ্বার এই কুলতলি। কৈখালি থেকে লঞ্চে সুন্দরবন ভ্রমণে যান অনেকে। কিন্তু গদখালি, ঝড়খালি-সহ সুন্দরবনে যাওয়ার অন্য প্রবেশদ্বারগুলির মতো পরিকাঠামো কৈখালিতে নেই। নিমপীঠ আশ্রমের একটি হোটেল ছাড়া নেই তেমন থাকার জায়গাও। কৈখালিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি উঠছে বহু দিন ধরে। শুধু কৈখালিই নয়, মৈপিঠ, ঢাকিকে কেন্দ্র করেও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে। স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, এই সব এলাকার পরিকাঠামোর উন্নতি হলে, অনেক বেশি পর্যটক আসবেন। এলাকার অর্থনৈতিক ছবি বদলাবে। পিয়ালি নদীকে কেন্দ্র করে একটি পর্যটন কেন্দ্র বাম আমলে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটিও বর্তমানে বেহাল।
নদী-খাঁড়িতে মাছ-কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করা মৎস্যজীবীদের উন্নতিতেও তেমন পদক্ষেপ নেই প্রশাসনের। যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়েও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এখনও সরাসরি রেল যোগাযোগ নেই কুলতলিতে। বাস চলাচল নিয়মিত নয়। বহু এলাকায় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম মোটরভ্যান। এলাকায় কাজের সুযোগ নেই। বেহাল যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য নিয়মিত শহর বা শহরতলিতে কাজে আসাও সমস্যা। ফলে দলে দলে মানুষ ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেন কাজের জন্য। করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় হাজার পাঁচেক পরিযায়ী শ্রমিক এলাকায় ফিরেছিলেন। তাঁদের অনেকে ফের ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন।
স্থানীয় বিধায়ক রামশঙ্কর হালদারের দাবি, কুলতলির উন্নতি যা হয়েছে, সবই সেই বাম আমলে। তিনি বলেন, “বামেরা সরকারে থাকাকালীন আমরা এই কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিলাম না। কিন্তু এলাকার উন্নতি হয়েছিল। রাস্তা, সেতু সবই সেই আমলে তৈরি। তৃণমূল জমানায় আমাদের কাজ করার সুযোগটাই দেওয়া হয় না। বিধানসভায় বার বার বলেও এলাকার মৎস্যজীবীদের জন্য কিছু আদায় করতে পারিনি। পর্যটন কেন্দ্র গড়ার জন্যও বার বার দরবার করেছি, কাজ হয়নি। বিধায়ক তহবিলের টাকা থেকে যতটা পেরেছি কাজ করেছি। স্কুলে দিয়েছি। শ্মশান, কবরস্থানের পরিকাঠামো উন্নতি হয়েছে। এলাকায় কল বসিয়েছি।” তাঁর অভিযোগ, “এই সরকার বিরোধীদের গুরুত্ব দেয় না। এলাকায় একাধিক প্রশাসনিক বৈঠকে ডাকাই হয়নি। আমপানে পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদের মাধ্যমে সরকারি ত্রাণ বিলি করা হয়েছে। অথচ নির্বাচিত বিধায়ককে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি।”
দীর্ঘ বাম জমানায় এই কেন্দ্রটি দখলে রেখেছিল এসইউসি। ২০১১ সালে রাজ্যে যখন তৃণমূল ক্ষমতায় এল, তখন প্রথম বার এই কেন্দ্রে জেতে সিপিএম। বিধায়ক হন রামশঙ্কর। ২০১৬ সালে ফের জেতেন তিনি। কিন্তু এলাকার রাজনৈতিক চিত্রে আমূল পরিবর্তন হয় এর বছরখানেক পরে। ২০১৭ সালের পঞ্চায়েত ভোটে এই বিধানসভা কেন্দ্রের ১৩টি পঞ্চায়েতের অধিকাংশই দখলে নেয় তৃণমূল। বিরোধীদের অবশ্য অভিযোগ, ভোটে দুর্নীতি এবং পরবর্তীকালে নানা প্রলোভনে অন্য দলের সদস্য ভাঙিয়েই পঞ্চায়েত দখল করে তারা। তবে পঞ্চায়েত দখলের মাধ্যমে এলাকায় তৃণমূলের দাপট বাড়ে। সেই সঙ্গে অবশ্য প্রকট হয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও। মূল সংগঠনের পাশাপাশি মাথাচাড়া দেয় যুব সংগঠন। দল ভাঙানোর খেলা শুরু হয়। সিপিএম, এসইউসি থেকে বহু কর্মী যুব তৃণমূলে যোগ দেন। একাধিক পঞ্চায়েতে অন্য দলের জয়ী সদস্যও যুব তৃণমূলের ছাতার তলায় চলে আসেন। স্থানীয় মানুষ জানান, এর সঙ্গে সঙ্গেই রাজনৈতিক ভাবে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে সিপিএম। সংগঠন ভাঙে এসইউসিরও। গত কয়েক বছরে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ঢালাই রাস্তা, কল-সহ উন্নয়নের কিছু কাজ এলাকায় হয়েছে। সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদও কিছু কাজ করেছে। তবে সার্বিক উন্নয়নের নিরিখে সুন্দরবন লাগোয়া এই এলাকা পিছিয়ে রয়েছে অনেকটাই।
দলে দলে কর্মী-সমর্থক দল ছাড়ায় এলাকায় সিপিএম, এসইউসি এখন ক্ষয়িষ্ণু। গত কয়েক বছরে এলাকায় বিজেপির প্রভাব বেড়েছে। তবে সংগঠনে তারা এখনও পিছিয়ে। লোকসভা ভোটের নিরিখেও এই কেন্দ্রে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল।
কিন্তু দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ভাবাচ্ছে তৃণমূল নেতৃত্বকে। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই এলাকায় দলের মুখ গোপাল মাঝি। গত বিধানসভায় তৃণমূলের প্রার্থীও ছিলেন তিনি। তবে গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে ক্রমশ সামনের সারিতে উঠে এসেছেন এক সময়ে সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে আসা গণেশ মণ্ডল।
আগামী ভোটে কোন গোষ্ঠীর নেতা তৃণমূলের টিকিট পাবেন, সেই আলোচনাই আপাতত চলছে কুলতলির আনাচে কানাচে। গোপাল বলেন, “এই কেন্দ্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেওয়াই আমার প্রধান লক্ষ্য।” গণেশের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়ন যজ্ঞে সামিল হয়ে ইতিমধ্যেই অন্য দল থেকে বহু মানুষ আমাদের দলে এসেছেন।”
দুই নেতাই জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। যে পক্ষই টিকিট পাক, অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না দলের উঁচুতলার নেতারা। অনেকেই মনে করছেন, এই পথে লড়াইয়ে ঢুকতে মরিয়া বিজেপি। বিক্ষুব্ধ তৃণমূলের ভোট তাদের দিকে আসবে বলে আশাবাদী সিপিএম, এসইউসি-ও।
মুখে অবশ্য তৃণমূলের দুর্নীতিকে সামনে রেখেই লড়াইয়ে নামতে চাইছে সব পক্ষ। রামশঙ্করের কথায়, “এলাকায় গুন্ডারাজ শুরু করেছে তৃণমূল। আমপানের ক্ষতিপূরণ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। পঞ্চায়েতগুলি থেকে তৃণমূল নেতাদের পকেট ভরছে। সাধারণ মানুষ ইভিএমে জবাব দেবেন।” এসইউসির জয়কৃষ্ণ হালদার বলেন, ‘‘এখানে মানুষের রুটি-রুজি নেই। আমরা সে জন্য লড়াই করছি। প্রশাসনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ এই লড়াইয়ে আমাদের পাশে থাকবেন।’’ বিজেপির দক্ষিণ ২৪ পরগনা (পূর্ব) জেলা সভাপতি সুনীপ দাস বলেন, ‘‘লোকসভা ভোটে আমরা এই কেন্দ্রে দ্বিতীয় হয়েছি। নেতাদের দুর্নীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার সাধারণ মানুষ এ বার বিজেপিকেই জয়ী করবেন।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement