রূপান্তর: বাঁ দিক থেকে, পুরনো ভবন। ডান দিকে, বর্তমান অঙ্গশোভা।
দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে ওপার বাংলা থেকে ভিটে-মাটি ছেড়ে এদেশে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন বহু মানুষ। কার্যত অন্নবস্ত্রহীন, সে সব মানুষের তখন বেঁচে থাকাটাই ছিল বড় যুদ্ধ।
সে সময়ে বনগাঁর কিছু শিক্ষানুরাগী ও সমাজকর্মীরা ঠিক করেন, উদ্বাস্তু, নিরন্ন বুভুক্ষু পরিবারের সন্তানদের এবং স্থানীয় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার বিস্তার ঘটাবেন। সেই মতো ১৯৪৮ সালে পথচলা শুরু হয়েছিল বনগাঁ দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়ের।
তারপর থেকে কেবল এগিয়ে চলার গল্প।
মঙ্গলবার কলেজের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে শহরে বর্ণাঢ্য পদযাত্রার আয়োজন করা হয়েছিল। উপস্থিত ছিলেন অধ্যক্ষ বিশ্বজিৎ ঘোষ, পুরপ্রধান গোপাল শেঠ-সহ অনেকে।
স্বাধীনতার পরে একটা দীর্ঘ সময় ধরে বনগাঁ মহকুমায় একটিই মাত্র কলেজ ছিল, সেটি দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়। পরবর্তী সময়ে বাগদার হেলেঞ্চায়, গোপালনগরের নহাটায় এবং গাইঘাটার ঠাকুরনগরে আরও তিনটি কলেজ চালু হয়েছে। গাইঘাটায় তৈরি হয়েছে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ বিশ্ববিদ্যালয়। বনগাঁ মহকুমার মানুষ বিশ্বাস করেন, দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়টি না থাকলে মহকুমার কয়েকটি প্রজন্ম উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হত।
দীনবন্ধু কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন বনগাঁ শহরের বাসিন্দা রবীন্দ্রনাথ তরফদার। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অর্নাস নিয়ে স্নাতক হন। দীর্ঘদিন বনগাঁ হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। এখন অবসর নিয়েছেন। তিনি জানান, ১৯৪৮ সালে বনগাঁ হাইস্কুলে দীনবন্ধু কলেজেটি চালু হয়েছিল। দু’বছর পরে ১৯৫০ সালে কলেজটি চলে যায় দীনবন্ধুনগরে ইছামতী নদীর কাছে। কলেজ প্রতিষ্ঠার অনেক আগে বনগাঁ হাইস্কুল ১৮৬৪ সালে তৈরি হয়েছিল। বনগাঁর শিক্ষা প্রসারে বনগাঁ হাইস্কুলের অবদানও অস্বীকার করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘‘দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয় তৈরি হওয়ার আগে অনেকেরই উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল না। আমার বাবা তারকচন্দ্র ১৯৪২ সালে মাট্রিক পাশ করে আর নিয়মিত পড়াশোনা করতে পারেননি বনগাঁয় কলেজ না থাকায়। বাবা অবশ্য পরবর্তী সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেটে আইএ এবং বিএ পাশ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষকতার চাকরিও করেন।’’ তিনি জানান, আগে দীনবন্ধু কলেজ থেকে অনার্স পাশ করলে সরাসরি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া যেত।
কলেজের অনেক প্রাক্তনী মনে করেন, বনগাঁ মহকুমায় এখন অনেক স্কুল-কলেজ হলেও শিক্ষার মান কমেছে। এক প্রবীণ প্রাক্তনীর কথায়, ‘‘আমাদের সময়ে কেউ বিএ পাশ করলে তাঁর সামাজিক মর্যাদা বেড়ে যেত। আশপাশের এলাকার লোকজন দেখতে আসত তাঁকে। এখন সেই কৌলিন্য নেই।’’
এই কলেজের প্রাক্তনী কবি মলয় গোস্বামীর বয়স ৬৮। ১৯৭৩ সালে স্নাতক হয়েছিলেন। স্মৃতিতে ডুব দিয়ে বললেন, ‘‘তখন কলেজের পরিবেশ ছিল অনেক অন্য রকম। আমরা শিক্ষকদের রীতিমতো ভয় করতাম। কলেজের সহপাঠিনীদের আপনি সম্বোধন করে কথা বলার রেওয়াজ ছিল।’’ তাঁর মতে, অর্পণা সেন অভিনীত, তপন সিংহ পরিচালিত ‘এখনই’ ছবি রিলিজ হওয়ার পর থেকে এই রীতি বদলাতে থাকে। ওই ছবিতে কলেজের সহপাঠীরা একে অন্যকে ‘তুই’ সম্বোধন করেতেন। মলয় জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কলেজ কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় সৈনিকেরা কলেজে শিবির করেন। সৈন্যেরা কামান দাগতেন সেখানে।
মলয়ের কথা, ‘‘আমাদের সময়ে শিক্ষার গুণগত মান উন্নত ছিল। শিক্ষকেরা কলেজে যা পড়াতেন, তারপরে আর গৃহশিক্ষকের সাহায্য দরকার পড়ত না।’’ কলেজের প্রাক্তন ছাত্র তথা কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক জ্যোতির্ময় ঘোষ জানালেন, ১৯৬২-৬৩ সাল পর্যন্ত পড়েছেন এখানে। তখন নদিয়ার চাকদহে কলেজে ছিল না। সেখান থেকেও দীনবন্ধু কলেজে ছেলেমেয়েরা আসতেন। তাঁর মতে, উদ্বাস্তু, তফসিলি, নমঃশূদ্র-সহ বহু পরিবারের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার প্রসারে কলেজটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধের সময়েও কলেজ বন্ধ হয়নি।
এখন কলেজে পড়ুয়ার সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। অধ্যক্ষ বলেন, ‘‘১৯টি বিষয়ে অর্নাস-সহ ২৩টি বিষয় পড়ানো হয়। ২০১১ সাল থেকে কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গিয়েছে। তবে কলেজের গরিমা একই আছে।’’
প্রথম বর্ষের ছাত্রী মৌ রায় বলেন, ‘‘বাড়ির কাছে এমন ভালমানের একটি কলেজ পেয়ে আমরা উপকৃত হয়েছি। শিক্ষক-শিক্ষিকারা যত্ন নিয়ে পড়ান।’’