সুদীপ্ত বসুঠাকুর
মেয়ের স্কুলে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে সপ্তাহান্তের ছুটিতে বড় সাধ করে সুন্দরবন বেড়াতে গিয়েছিলেন ওঁরা।
যাদবপুরের বাসিন্দা সুদীপ্ত বসুঠাকুর রবিবার কলকাতায় ফিরলেন শরীরে গুলির ক্ষত নিয়ে। ডাকাতেরা হোটেলের ঘরে ঢুকে বেধড়ক মারধর করে টাকাপয়সা লুঠ করে নিয়ে গিয়েছে।
শনিবার রাতে যখন এই তাণ্ডব চলছে, কলকাতার অদূরে পিয়ালি দ্বীপের লজ থেকে ‘১০০’ ডায়াল করেছিলেন সুদীপ্তর স্ত্রী সংঘমিত্রা। পরপর দু’বার। ফোন টানা বেজে গিয়েছে, সাড়া মেলেনি। পরে আর্ত চিৎকার শুনে লজের এক বাসিন্দাই ফোন করে কলকাতায় তাঁর এক পরিচিত পুলিশ অফিসারকে বিষয়টি জানান। সেই সুবাদেই পুলিশ যত ক্ষণে এসে পৌঁছয়, তত ক্ষণে কেটে গিয়েছে পৌনে এক ঘণ্টা।
রাজ্য পুুলিশের ওয়েবসাইট খুললেই ঘটা করে ‘১০০’ ডায়ালের ঘোষণা চোখে পড়ে। বিপদগ্রস্তদের জন্যই নাকি এই পরিষেবা। তবে সেটা যে কার্যত ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ, তা শনিবার রাতেই তার প্রমাণ পেলেন সুদীপ্তবাবুরা।
শনিবার কলকাতার চারটি পরিবার কুলতলি থানার পিয়ালি দ্বীপের কেল্লার ঘাটে বেড়াতে গিয়েছিল। পুলিশ জানায়, রাত পৌনে দু’টো নাগাদ হোটেলের দোতলায় সুদীপ্ত বসুঠাকুরের ঘরে ডাকাত ঢোকে। লুঠপাট চালানোর সময় বাধা দিলে ডাকাতেরা দু’টি গুলি ছোড়ে। তাতে জখম হন সুদীপ্তবাবু। পাশাপাশি ওই দলে থাকা মিহির মুখোপাধ্যায় নামে আর এক ব্যক্তির ঘরেও ডাকাতি হয়।
পিয়ালির এই রিসর্টেই হামলা চালায় ডাকাতেরা। —নিজস্ব চিত্র।
সুদীপ্তবাবুর স্ত্রী সংঘমিত্রা অভিযোগ করেন, পৌনে তিনটে নাগাদ ডাকাতেরা পালিয়ে যাওয়ার পরে তিনি ‘১০০’ ডায়ালে দু’বার ফোন করেছিলেন। কিন্তু সাড়া মেলেনি। কিছুক্ষণ পরে আক্রান্ত পরিবারগুলির চিৎকার শুনতে পান ওই লজেরই এক পর্যটক। পুলিশ সূত্রের খবর, ওই ব্যক্তি কলকাতা পুলিশে কর্মরত। তিনিই লালবাজার মারফত দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশকে খবর দেন। সেখান থেকে কুলতলি থানা খবর পায়। পুলিশ এসে সুদীপ্তবাবুকে স্থানীয় ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে চিকিৎসা করায়। রবিবার তাঁকে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, এক্স-রে পরীক্ষায় সুদীপ্তবাবুর দেহের ভিতরে গুলি বিঁধে নেই বলেই জানা গিয়েছে। শরীরে একাধিক ক্ষত থাকলেও কোনও হাড় ভাঙেনি। আপাতত তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল।
রবিবার বিকেলে পুলিশ এই ঘটনায় ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। উদ্ধার করা হয়েছে লুঠ করা মোবাইল ফোন, ঘড়ি, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডগুলি। পুলিশ জানায়, ধৃতদের নাম মোতালেব মোল্লা, সৌকত মোল্লা, হাকিম লস্কর, ভোলা সর্দার, সুজা মল্লিক, ইবাদ আলি গাজি ও মুজিবর লস্কর। তারা প্রত্যেকেই কুলতলির বাসিন্দা। বাকিদের খোঁজেও তল্লাশি চলছে। এখনও অবধি লুঠ হওয়া টাকার মধ্যে ১৩ হাজার ৭০০ টাকা উদ্ধার হয়েছে বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন।
কিন্তু ১০০ ডায়াল করার পরেও তাৎক্ষণিক পুলিশি সহায়তা কেন পেলেন না ওই পর্যটকেরা? পুলিশ একটি সূত্র বলছে, মোবাইল থেকে ‘১০০’ ডায়ালে ফোন করলে নিকটবর্তী থানা অথবা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন যায়। তা হলে কুলতলি থানা কিংবা আলিপুরে জেলা পুলিশের কন্ট্রোল রুমে ফোন বেজে গেল কেন? জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, আলিপুর কন্ট্রোল রুমে ১০০ ডায়াল ব্যবস্থা নেই। তা হলে সংঘমিত্রা যে ফোন বেজে যাওয়ার কথা বলেছেন, তা কোন জায়গার? এ ব্যাপারে কোনও সদুত্তর মেলেনি পুলিশের কাছ থেকে। বিএসএনএলের এক কর্তা জানাচ্ছেন, কলকাতা এবং রাজ্যের সব জেলা পুলিশের থানা ও কন্ট্রোল রুমে নাগরিকদের জন্য এই আপৎকালীন পরিষেবা চালু করা রয়েছে। বিএসএনএল-ও এই পরিষেবার ক্ষেত্রে আলাদা গুরুত্ব দেয়।
কী ভাবে চলে এই পরিষেবা?
বিএসএনএল সূত্রের খবর, ‘১০০’ নম্বরটি কোনও নির্দিষ্ট ফোনের নম্বর নয়। এটি একটি পরিষেবার নম্বর। তাই এক-একটি এলাকা ধরে ১০০ নম্বরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানা এবং জেলা পুলিশের কন্ট্রোল রুমের নম্বর ‘ম্যাচিং’ করানো রয়েছে। তার ফলে কেউ ১০০ নম্বরে ফোন করলে প্রথমে তা স্থানীয় থানায় যাবে। থানায় তিন বার রিং হওয়ার পরে সাড়া না মিললে সেই ফোন নিজে নিজেই চলে যাবে জেলা কন্ট্রোল রুমে। “ফোনের টাওয়ার না ধরলেও ১০০ নম্বরে ডায়াল করা যায়। কারণ এটি জরুরি পরিষেবা,” বলছেন এক বিএসএনএল কর্তা।
সংঘমিত্রার অভিযোগ, সন্ধ্যায় তিনি হোটেলের কাছে কয়েক জন পুলিশকর্মীকে দেখেছিলেন। কিন্তু রাতে তাঁদের দেখতে পাননি। ওই হোটেলের কাছে একটি পুলিশ ফাঁড়িও রয়েছে। তা হলেও কেন পুলিশ পৌঁছতে দেরি হল?
জেলা পুলিশের কর্তাদের ব্যাখ্যা, সন্ধ্যায় ওই ফাঁড়ির কর্মীদেরই সংঘমিত্রা দেখেছিলেন। রাতে ফাঁড়ির কর্মীরা টহলদারিতে বেরনোর পরেই ডাকাতদল হানা দেয়। খবর পাওয়ার পর ওই পুলিশকর্মীরাই ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলেন। পুলিশ সূত্রের খবর, সংঘমিত্রাদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য দুষ্কৃতীদের কাছে ছিল। ফাঁড়ির পুলিশরা কখন টহলে বেরোন, তা-ও তাদের জানা ছিল। সেই মতোই তারা হানা দিয়েছে। “তা না-হলে একতলা ছেড়ে দোতলার দু’টো ঘরেই হানা দিল কেন!” বলছেন এক পুলিশকর্তা।
প্রশ্ন উঠেছে, পর্যটকেরা যদি বিপদে পড়ে জরুরি পরিষেবা না পান, তা হলে সেটা কি রাজ্যের পর্যটন চিত্রের উপরে ছাপ ফেলবে না? রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসু অবশ্য এটিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখছেন। তিনি বলেন, “ঘটনাটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বিদেশেও এ রকম ঘটনা ঘটে। তা বলে কি লোকে সেখানে যায় না!” কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল ও তাতে স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের কোনও গাফিলতি ছিল কি না, তা জানতে এসপি-র সঙ্গে কথা বলেছেন মন্ত্রী। বিষয়টি নিয়ে রিপোর্টও চেয়েছেন তিনি।
পর্যটন দফতর সূত্রের খবর, বেসরকারি লজগুলিকে নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই সেই পরামর্শ মানা হয় না বলে পর্যটনকর্তাদের অভিযোগ।
শনিবার রাতের এই ঘটনার পরে অবিলম্বে পিয়ালি আইল্যান্ড ট্যুরিস্ট লজে একটি স্থায়ী ক্যাম্প বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা পুলিশ। সেই জন্য পর্যটক আবাস কর্তৃপক্ষের কাছে একটি ঘরও চাওয়া হয়েছে কুলতলি থানার তরফে। ট্যুরিস্ট লজ-এর পরিচালকেরা জানিয়েছেন, অতিথিদের থাকার জন্য ১৬টি ঘর ছাড়াও অন্য কয়েকটি ঘর রয়েছে। তার একটি পুলিশকে দেওয়া হবে। ওই লজটি লিজ নিয়েছে যে সংস্থা, তার অন্যতম ডিরেক্টর প্রদীপ দেব এ দিন বলেন, “আমাদের লজে এসে ওই পর্যটকেরা আক্রান্ত হলেন, ওঁদের এত বড় ক্ষতি হল। সেই জন্য আমাদের লজে থাকাখাওয়া বাবদ যা খরচ হয়েছে, সব ওঁদের ফেরত দেব।”