—প্রতীকী চিত্র।
‘‘ওয়ার্ল্ড কাপ হ্যায়, পটাকা তো চাহিয়ে!’’ উৎকণ্ঠিত গলায় বারবার একই দাবি জানাচ্ছেন ভিন্ রাজ্যের ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বিশ্বকাপের সুবাদে এ বার দেড় গুণ বরাত পেয়েও বিস্ফোরণের ঘটনার পর অন্য রাজ্যে বাজি পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন দত্তপুকুরের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, ভিন্ রাজ্যের ক্রেতারা পুলিশ ও নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করার পরামর্শ দিচ্ছেন।
বছরভর ভিন্ রাজ্যে এ রাজ্য থেকে বিপুল পরিমাণ বাজি রফতানি হয়। অসম, ত্রিপুরা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যে চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ইতিমধ্যে ক্রেতারা অগ্রিমও দিয়েছেন। বাজি ব্যবসায়ীরা জানালেন, বরাত দেওয়ার সময়ই ৫০ শতাংশ টাকা দেওয়ার নিয়ম। বাকি টাকা মেলে বাজি পৌঁছনোর পর। কিন্তু দত্তপুকুরের মোচপোল পশ্চিমপাড়ার বিস্ফোরণের ঘটনায় উদ্বিগ্ন ক্রেতারা। সামনেই ক্রিকেট বিশ্বকাপ ও উৎসবের মরসুম। বাজি পাঠানোর তাগাদা দিয়ে ঘন ঘন ফোন আসছে তাঁদের। এ দিকে পুলিশি নজরদারির জেরে আপাতত বাজি কারখানাগুলিতে কাজ থমকে রয়েছে। তাই আতান্তরে এ রাজ্যের বাজি নির্মাতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারায়ণপুরের আর এক বাজি ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘এখানেই আছে শতাধিক বাজির গুদামঘর। ঘরে ঘরে বাজি মজুত আছে। এ বছর দেড় গুণ বরাত পেয়েছি আমরা। কিন্তু বিস্ফোরণের কারণে এখান থেকে বাজি অন্যত্র সরিয়ে সেখান থেকে পাঠাতে হবে। ফলে, খরচ বেড়েছে। তা ছাড়া গাড়িও পাওয়া যাচ্ছে না।’’
দত্তপুকুরে বিস্ফোরণের পর এলাকার বহু মানুষ বেআইনিভাবে বাজি তৈরির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, এখনও পুলিশি তল্লাশি চলছে ঢিমে তালে। এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটা গুদামে হানা দিয়েই কাজ গোটানোর চেষ্টা চলছে। আরও অভিযোগ, রাতের অন্ধকারে বেরুনানপুকুরিয়া, মোচপোল, কাঠোর, জালশুখা এলাকার একাধিক বাড়ি ও গুদাম থেকে সরানো হচ্ছে বাজি, মশলা। এলাকার অনেকেই এ কাজের সঙ্গে যুক্ত। ক্রেতাদের কাছেও বাজি পৌঁছে যাচ্ছে।
মোচপোল পশ্চিমপাড়াতেই রয়েছে প্রায় দশটি গুদাম ঘর। অভিযোগ, বিস্ফোরণস্থলের ঢিল ছোড়া দূরত্বে দু’টি দোকানে মজুত আছে বস্তা বস্তা নিষিদ্ধ বাজি। পুলিশের চোখে ধুলো দিতে ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া, পঞ্জাব সরকার, কর্নাটকের চিনি কলের সরকারি ছাপ দেওয়া বস্তায় ভরে বাজি দূরে পাঠানো হত। অভিযোগ, সব জেনেও পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করছে না। কাছেই এক বাজি ব্যবসায়ীর বাড়ি। ফোনে তিনি বলেন, ‘‘পুলিশকে সামলানো কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু মিডিয়া বসে আছে। তাই বাজি সরাতে পারছি না। একটা বিস্ফোরণের জন্য বাকিদের বিপদে পড়তে হচ্ছে।’’ তাঁর দাবি, সরকারি ছাপ মারা ওই বস্তাগুলো ভিন্ রাজ্যের ব্যবসায়ীদের দেওয়া।
পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, বিপুল পরিমাণ বাজি উদ্ধার হয়েছে। এখান থেকে বাজি সরিয়ে শাসন, দেগঙ্গা, আমডাঙা ও খড়দহ থানা এলাকায় রাখার বন্দোবস্ত চলছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু ট্রাক বাজি সরানো হয়েছে। যদিও বিস্ফোরণের ঘটনার পর দত্তপুকুর থানার আইসি ও নীলগঞ্জ আউটপোস্টের ওসিকে সাময়িক বরখাস্ত করায় ক্ষিপ্ত পুলিশের একাংশও। এক পুলিশকর্মীর কথায়, ‘‘যত দোষ পুলিশের! কোনও নেতাকে কিন্তু বরখাস্ত করা হয় না। অথচ আমাদের চলতে হয় নেতা, জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশে।’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বারাসত পুলিশ জেলার এক আধিকারিকের খেদোক্তি, ‘‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। আমরা আজ্ঞাবহ মাত্র।’’ কর্তা কে? হেসে তিনি বলেন, ‘‘সে তো সবাই জানে। নাম নিয়ে বিপদে পড়তে চাই না।’’
এ বিষয়ে বারাসত পুলিশ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিশ্বচাঁদ ঠাকুর বলেন, ‘‘তল্লাশি চালিয়ে ৬০ টনের বেশি বাজি উদ্ধার করা হয়েছে। কয়েকজন অভিযুক্তের খোঁজ চলছে। গ্রামবাসীরা আমাদের কাছে অভিযোগ জানালে অবশ্যই পদক্ষেপ করব।’’
স্থানীয় বিধায়ক তথা খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষ বলেন, ‘‘এখানে অনেক আগে থেকেই বাজি কারখানা ছিল। বর্তমানে বেড়েছে তা ঠিক। গ্রামবাসীরা পুলিশকে জানিয়েছেন। আমাকে বা পঞ্চায়েত প্রধানকে জানান। ফলে জানতে পারিনি। আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি, পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হোক। জড়িতেরা যে দলেরই হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিক আদালত।’’