উত্তেজিত জনতার সামনে তখন হতভম্ব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ছবি: নির্মল বসু।
আদিবাসীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের জেরে বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তুলকালাম চলল বসিরহাটে। দফায় দফায় ঘেরাও করা হয় মহকুমাশাসকের অফিস, বাংলো। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরে ঢুকে গালিগালাজ করা হয় তাঁকে। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির পরিস্থিতি তৈরি হয় আন্দোলনকারীদের। একটা সময়ে মহকুমাশাসকের বাংলোর শাটার বাইরে থেকে ফেলে দেন বিক্ষোভকারীরা। ভিতরে আটকে পড়েন পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তারাও। শেষমেশ বহু চেষ্টায় পরিস্থিতি শান্ত করেন সরকারি আধিকারিকেরা। বেলা ১টার পর থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত অবরুদ্ধ থাকা বোটঘাট-ইটিন্ডা রোডে অবরোধও ওঠে।
এগারো দফা দাবি নিয়ে এ দিন মহকুমাশাসক নীতেশ ঢালিকে স্মারকলিপি দিতে আসবেন বলে আগে জানিয়ে রেখেছিলেন আদিবাসীরা। সেই মতো বৃহস্পতিবার বেলা ১টা নাগাদ সন্দেশখালি, মিনাখাঁ, হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ, হাড়োয়া থেকে কয়েকশো আদিবাসী মিছিল করে বসিরহাটে আসেন। তাঁদের হাতে ছিল তির-ধনুক, ত্রিশূল, লাঠিসোঁটা। শুরু থেকেই রুদ্রমূর্তিতে দেখা গিয়েছে তাঁদের। পুরোভাগে ছিলেন মহিলারাই। রাস্তায় বসে অবরোধ শুরু করে দেন তাঁরা।
‘ভারতীয় আদিবাসী ও তফসিলি জাতি উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি সংগঠনের ছাতার তলায় এ দিন বিক্ষোভ দেখিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। তাঁদের অভিযোগ, আদিবাসীদের শংসাপত্র পেতে হলে ঘুষ নেওয়া হচ্ছে। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ না হলে সরকারি সুযোগ-সুবিধা মিলছে না। একশো দিনের কাজ পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না। তৃণমূলের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের অভিযোগ ভুরি ভুরি। অপরাধীদের তারা মদত দিচ্ছে বলেও অভিযোগ। এমনকী, পুলিশ-প্রশাসনও শাসক দলের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। আদিবাসীদের জমি জোর করে দখল করা হচ্ছে। অভিযোগ, পুলিশ-প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েও কোনও লাভ হচ্ছে না।
কিন্তু এ সব কথা মহকুমাশাসককে জানিয়ে কী লাভ? আন্দোলনকারীদের নির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ আছে মহকুমাশাসক নীতেশ ঢালির বিরুদ্ধেও। তাঁদের বক্তব্য, বারাসতে সরকারি অফিসারের দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি হাজারখানেক আদিবাসীকে শংসাপত্র দেবেন বলেও বঞ্চিত করেছেন। এখন আবার বসিরহাটের মহকুমাশাসক হয়ে বসেছেন।
এই সব অভিযোগ তুলে এগারো দফা দাবিতে এ দিন স্মারকলিপি দেওয়ার কথা ছিল মহকুমাশাসককে। বেলা ১টা থেকে এসডিও অফিসের সামনে গোলমাল বাড়তে থাকে। মহকুমাশাসকের ঘরে গিয়ে স্মারকলিপি দেওয়ার দাবি জানাতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। উত্তেজনা থাকায় প্রথমে পুলিশ রাজি হতে চায়নি। কিন্তু পরিস্থিতি তাতে আরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে মনে করে পুরুষ-মহিলাদের দু’টি দলে ভাগ হয়ে দফতরে ঢোকার অনুমতি দেয় পুলিশ। সেই মতো জনা পনেরো মহিলা গিয়ে এসডিও-র ঘরে আধিকারিককে গালিগালাজ করে আসেন।
তখনও তাঁরা জানতেন না, মহকুমাশাসক এ দিন অফিসেই নেই। স্মারকলিপি নেওয়ার জন্য আছেন একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সেটা জানাজানি হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই। যখন পুরুষরা জনা পনেরো দল বেঁধে ঢোকেন এসডিও-র ঘরে। এসডিও ভেবেই কেউ কেউ মোবাইলে ছবি তোলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সঞ্জয় হাওলাদারের। প্রবল চিৎকার-চেঁচামেচির সামনে তখন কার্যত অসহায় দেখাচ্ছিল সঞ্জয়বাবুকে। তিনি এটুকু বলার সুযোগ পাননি, তিনি আদৌ মহকুমাশাসক নন।
সেটা তখনই বললে যে কী পরিস্থিতি হত, তা বোঝা যায় অল্প সময়ের মধ্যেই। এ বার মোবাইলে ছবি তুলে বাইরে এসে বিক্ষোভকারীরা বাকিদের ওই ছবি দেখান। ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ কেউ বলে ওঠেন, ইনি তো এসডিও নন।
ব্যস, আগুনে ঘি পড়ে। স্মারকলিপি নিতে কেন হাজির থাকেননি এসডিও, তা নিয়ে তুলকালাম শুরু হয়। আদিবাসী সংগঠনের নেতা সুকুমার সর্দার-সহ কয়েক জন পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেন।
ইতিমধ্যে একদল বলে, মহকুমাশাসক অফিসে নেই যখন, তিনি নিশ্চয়ই বাংলোতে আছেন। সেই মতো কিছু লোক বাংলো ঘেরাও করতে চলে যায়। পুলিশ-প্রশাসনের একাধিক কর্তা ছিলেন সেখানে। তাঁরা উত্তেজিত জনতাকে কিছুই বুঝিয়ে উঠতে পারেননি। আগাগোড়া আন্দোলনকারীরাই ছিল মারমুখী। তারা দফতরের শাটার নামিয়ে দেয়। প্রায় আধ ঘণ্টা ভিতরে আটকে পড়েন সরকারি আধিকারিকেরা। পরে আরও পুলিশ এসে দীর্ঘক্ষণ আলোচনার পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
মহকুমাশাসক নীতেশ ঢালি মোবাইলে কথা জানিয়েছেন, জরুরি কাজে এ দিন দফতর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্মারকলিপি নেওয়ার জন্য একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের অফিসারকে রেখে গিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কেন এ সব অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা নিয়েও অন্ধকারে নীতেশবাবু। সঞ্জয়বাবু বলেন, ‘‘ওঁরা চিৎকার-চেঁচামিচির মধ্যে আদপে কী দাবি বা অভিযোগ জানাতে চেয়েছেন ভাল মতো বুঝতেই পারিনি। তবে লিখিত ভাবে যে স্মারকলিপি দিয়েছেন, তা ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেবো।’’
যে সমস্ত অভিযোগ এ দিন তুলেছেন সুকুমার সর্দার, সবিতা সর্দারদের মতো আদিবাসী নেতৃত্ব, তার অধিকাংশই শাসকদলের দিকে। ক’দিন আগে ন্যাজাটে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সে প্রসঙ্গ টেনে সুকুমারবাবুরা বলেন, ‘‘শিক্ষিত আদিবাসী যুবক-যুবতীরা কী এখন হাঁস-মুরগি চাষ করবে? আদিবাসীদের কর্মসংস্থান নিয়ে তো একটা শব্দও খরচ করলেন না মুখ্যমন্ত্রী!’’
এ দিন বিক্ষোভকারীদের মঞ্চে স্থানীয় এক বিজেপি নেতাকেও কিছু সময়ের জন্য দেখা গিয়েছিল। সে ব্যাপারে বসিরহাটের সাংসদ তথা তৃণমূল নেতা ইদ্রিশ আলি বলেন, ‘‘এর থেকেই পরিষ্কার, বিজেপি আদিবাসীদের উসকানি দিয়ে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে। যার পরিণামে এ দিনের ঘটনা।’’ বিষয়টি ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সময়েই সচেষ্ট বলে তাঁর দাবি।
যার পাল্টা বসিরহাট দক্ষিণের বিধায়ক তথা বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘আন্দোলনকারীরা অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া এবং উপেক্ষিত। ওঁদের দাবির বিষয়ে আমাদের সমর্থন আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটা বিজেপির আন্দোলন নয়। তবে এমন আন্দোলনে দলের কেউ যদি যায়, তা হলে তার দায় তাঁকেই নিতে হবে।’’