চাষের জমির মাটি কেটে চলে যাচ্ছে ইটভাটায়। চুল্লিতে পুড়িয়ে সেই মাটি ইট হয়ে রাজ্যের নানা প্রান্তে পাড়ি দিচ্ছে। আজ যা ছিল সবুজ ধানখেত, কাল সেখানেই তৈরি হচ্ছে জলাশয়। আর এ ভাবেই সরকারের নজর এড়িয়ে বদলে যাচ্ছে জমির চরিত্র।
বসিরহাটের নানা প্রান্তে এই চিত্র দেখা যাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। কখনও চাষি স্বেচ্ছায় বিক্রি করছেন চাষের জমির মাটি। কৃষিজমি দখলের জন্য কিছু দালালও সক্রিয়। তারা কখনও টাকার টোপ দিয়ে, কখনও ভয় দেখিয়ে জমির দখল নিচ্ছে বলে অভিযোগ। কখনও কখনও আশপাশের জমি কিনে ক্রমশ মাটি কাটায় ধস নামছে অন্যের চাষের জমিতে। এক সময়ে জমির মালিক নিজের জমি বাধ্য হয়ে তুলে দিচ্ছেন ইটভাটা মালিকের হাতে, উঠছে এমন অভিযোগ।
এ বিষয়ে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের দেখভাল তেমন নেই বলেই জানাচ্ছেন গ্রামের মানুষ। সংশ্লিষ্ট দফতরের দাবি, কেউ যদি সরকারি জমিতে মাটি কাটে, বা জমির মালিকের অনুমতি ছাড়া মাটি কাটে বলে অভিযোগ ওঠে, তখন প্রশাসনের ভূমিকা থাকে। না হলে প্রশাসনের বিশেষ কিছু করার থাকে না।
ইটভাটায় পলিমাটির কদর চিরকালই। নদীরপাড়ের মাটি তুলে ব্যবহার হয় ভাটায়। ইদানীং আবার চাষের জমির এঁটেল মাটিতেও নজর গিয়েছে ব্যবসায়ীদের। জানা যাচ্ছে, বাজারে এঁটেল মাটির তৈরি ইটের দাম কিছুটা বেশি হওয়ায় এই
প্রবণতা বাড়ছে।
বসিরহাট ধলতিথা ব্রিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ সম্পাদক সুব্রত দে বলেন, ‘‘বসিরহাট মহকুমায় ইটভাটা আছে ৬৭৯টি। এর মধ্যে বাদুড়িয়া, বেড়াচাঁপা, কচুয়া, ভেকুটিয়ার মতো জায়গায় ১০-১২টি ভাটা নোনামাটি বা পলিমাটির বদলে ‘মিঠেন মাটি’ অর্থাৎ চাষের জমির মাটি কিনে তা দিয়ে ইট করে। যারা জমির মাটি দিয়ে ইট গড়ছে, তাদের বলা হয়েছে পলিমাটি দিয়ে ইট গড়তে।’’ বাদুড়িয়ার তৃণমূল বিধায়ক আব্দুর রহিম দিলু বলেন, ‘‘সরকারি অনুমতি ছাড়া কৃষিজমি থেকে মাটি কেটে ইট তৈরি করা হলে সে বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমা রাজ্যে ইটশিল্পের অন্যতম জোগানদার। কিন্তু ইছামতী এবং বিদ্যাধরী নদীর তীরে গড়ে ওঠা ভাটাগুলি পর্যাপ্ত পলিমাটি পায় না। কোথাও নদী মরে গিয়েছে। কোথাও সারা বছর জোয়ারের জল থাকে না। তাই প্রয়োজন মতো পলিমাটি মেলে না। ফলে ভাটা থেকে একটু দূরে হলেও চাষের জমি কেটে মাটি ভাটায় ব্যবহার হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অনেকে জানান, মূলত অনাবাদী এবং একফসলি জমির মাটিই কাটা হয়। অনেক জমির মালিক নিজেরাই প্রতি একশো ঘনফুট মাটি ৫-৬ শো টাকায় ভাটায় বিক্রি করেন। রক্তিম ঢালি, পলাশ মণ্ডলরা জানালেন, এক বিঘা জমিতে চাষের খরচ ৫-৭ হাজার টাকা। এক বিঘা জমির উপরভাগের মাটি এক বর্গ ঘনমিটার করে কেটে নেওয়ার জন্য ভাটা মালিককে দিলে মেলে ১০-১৫ হাজার টাকা। যদি ৮-১০ ফুট গভীর পর্যন্ত খননের অনুমতি দেন চাষি, তা হলে প্রায় তিন-সাড়ে তিন লক্ষ টাকা পাওয়া যায়। যা সারা বছর চাষ করেও মেলে না বলে জানালেন চাষিরা।
বাদুড়িয়া আগাপুরের চাষি আলমগির মণ্ডল বলেন, ‘‘আমার আড়াই বিঘা কৃষিজমিতে চাষ করেও মুনাফা হচ্ছিল না। ইটভাটা মালিকের কাছে মাটি বিক্রি করেছি। বিঘা প্রতি মিলেছে দু’লক্ষ টাকা। দশ ফুট গভীর মাটি কেটে নেওয়ায় সেখানে এখন মাছ চাষ করছি। যা থেকে বছরে বিঘা প্রতি ১৫-২০ হাজার টাকা ঘরে লাভ আসছে।’’বসিরহাটের মাটিয়া এলাকার এক চাষি রতন সাহা বলেন, ‘‘ফসলের যা দাম, পুকুর কাটলে বেশি লাভ হয়। তাই একটু একটু করে অনেকেই জমি চাষের পরিবর্তে মাটি বিক্রির পথ বেছে নিয়েছেন।’’
বসিরহাটের কয়েক জন চাষি জানালেন, বাড়ির ছেলেপুলেরা এখন চাষ করতে চায় না। অনেকে কাজকর্ম খুঁজে ভিন্ রাজ্যে চলে যাচ্ছে। চাষের জমি দেখভালের লোক লোক মেলে না ইদানীং। জমির মাটি বিক্রি করলে বরং এককালীন লাভ অনেক বেশি হয় বলে জানালেন অনেকেই।
সব মিলিয়ে গ্রামবাংলার সবুজ মাঠঘাট কত দিন ফসলের আঁতুড়ঘর হয়ে থাকবে, উঠছে সে প্রশ্ন।