সহপাঠিনীদের মধ্যমণি বিভা মালিক। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।
ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী বিভাকে একদিন তার মা সাজিয়ে-গুজিয়ে বসিয়ে দিলেন কিছু অপরিচিত লোকজনের সামনে। বিভা তখনও জানে না, কনে দেখানো হচ্ছে। তার জন্য পাত্রও খুঁজে ফেলা হয়েছে। টের পেতেই আপত্তি বিভার, ‘বিয়ে করব না।’ কেউ যখন তার কথা শুনতে রাজি নয়, তখন স্কুলকে জানিয়ে দেয় সে। মেয়ের জেদের সামনে হার মানে পরিবার।
এখন বিভা মালিক পড়ছে মালঞ্চ হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে। ভলিবল খেলতে রাজ্যের বাইরেও যায়। আর বিভার মস্ত কাজ, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রচার করা। স্কুলের সবক’টি বাল্যবিবাহ-বিরোধী প্রচারে সে সামিল হয়, জানালেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। তার স্কুলের দশম শ্রেণির একটিমেয়ের বিয়েও আটকেছে বিভা ও তার বন্ধুরা।
হালিশহরের বীজপুর থানার অধীনে মালঞ্চ গ্রামের বাসিন্দা বিভার বাবা যক্ষ্মারোগী, পেশায় জোগানের মিস্ত্রি। মা পরিচারিকার কাজ করেন। কোনও রকমে সংসার চলে। তবু বিভা বিয়ে করে সচ্ছল সংসারের স্বপ্ন দেখেনি। বরং পড়াশোনা করে সংসারে সাহায্য করতে চায় সে, চায় বাবার চিকিৎসা করাতে। অথচ মালঞ্চ গ্রামের অনেক মেয়েরই বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের ঢের আগে। বিশেষ করে তফসিলি জাতির মধ্যে বিশ্বাস, মেয়ের বয়স বেশি হয়ে গেলে ভাল পাত্র মেলে না। গ্রামে প্রায় ছ’শো পরিবার তফসিলি জাতির। ফলে অধিকাংশ মেয়েই বাল্যবিবাহের কবলে পড়ে। দুলে ও মালিক সম্প্রদায়ের মেয়েদের মধ্যে এবারই প্রথম একজন মাধ্যমিক দিয়েছে, জানালেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।
কেন আর পাঁচটা মেয়ের মতো বিয়ে করে নেয়নি বিভা? কারণ, তার এক দিদির বিয়ে হয়েছিল অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন। বিয়ের কিছু দিন পরেই স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শ্বশুরবাড়ির থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয় সেই মেয়েটি। এখন সে বাড়ি ফিরে এসে আবার স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ওই তরুণীর কথায়, “জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়টা কাটিয়ে উঠতে পেরে ভাল লাগছে। সেই সব কথা মনে পড়লে গায়ে কাঁটার মতো বেঁধে।”
কলকাতা থেকে হালিশহর ৫০ কিলোমিটারেরও পথ নয়। অথচ পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের রেখা কালিন্দী, বীণা কালিন্দীদের জীবনের কাহিনী অভিনীত হয়ে চলেছে হালিশহরের গ্রামে। বাল্যবিবাহের কুফল দেখে, লেখাপড়া শিখে সফল জীবনের আশায় মেয়েদেরই রুখতে হচ্ছে বিয়ের চেষ্টা। পাশে দাঁড়াচ্ছে স্কুল। বিভার কথায়, “সে দিন সবাইকে বোঝাতে কষ্ট হয়েছে। যখন কেউ আমার কথা শুনছে না, নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়েছে।” সবার সামনে বাড়িতে পুলিশ ডেকে বাবা-মাকে ছোট করতে চায়নি বিভা। অবশেষে অনেক কষ্টে স্কুলের সাহায্যে বিয়ে আটকেছে। কী ভাবে তা সম্ভব হয়েছে সেই কথা আর এখন বিভা ভাবতে চায় না। তবে, স্কুল চলাকালীনই বিভা তার বন্ধুদের বোঝায়, এই বয়সে বিয়ে করলে স্কুল জীবনের আনন্দ উপভোগ করবে কী করে? বাবা সুকুমার মালিক বলেন, “এখন আমরা মেয়ের পাশে আছি। ওর বিয়ে ঠিক করে ভুল করেছিলাম।” মা রিনা মালিকের কথায়, “আমারও ১২ বছরে বিয়ে হয়। কিন্তু এখন মনে হয় মেয়ের বিয়ে না হয়ে ভালই হয়েছে। আমরা চাই, বিভা নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক।”
সমবয়সীদের মতোই বিভা বিভোর তার স্বপ্ন নিয়ে। ভলিবল নিয়ে তার প্রত্যাশা আকাশছোঁয়া। তবে সংসারের যা পরিস্থিতি, তাতে সে কত দূর খেলাধুলো করতে পারবে তা নিয়ে চিন্তিত তার শিক্ষকেরা। তাঁদের কথায়, “এই সব খেলায় ভাল খাবার না পেলে অসুবিধা। কিন্তু ওদের অবস্থা ভাল নয়।” প্রধান শিক্ষক সুব্রত মিত্র জানান, অনুশীলনের জন্য বিভাকে মাঝেমধ্যেই টিফিনে ছুটি দেওয়া হয়। শিক্ষকদের তহবিল থেকে পড়াশোনা ও খেলার খরচও দেওয়া হয়। স্কুলে পড়তে টাকাও লাগে না বিভার।
পরে কী হবে, তা নিয়ে অত চিন্তিত নয় বিভা। এ বছর তার স্কুল তাকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য পুরস্কার দিয়েছে, তাতেই ভারি খুশি সে। বন্ধুরা কি সত্যিই কি মনে করে, বিভা তাদের আদর্শ? “তা মনে না-ই বা করল, তাড়াতাড়ি বিয়ে না করলেই হল,” বলল বিভা।