দিনের বেশির ভাগটাই ঘরকন্না নিয়ে ব্যস্ত ওঁরা। আর সেই কাজ সামলাতে গিয়ে নাগরিক সমস্যাগুলি আরও বেশি করে চোখে পড়ে ওঁদের। সে সব নিয়ে কথা বলতেও বেশ স্বচ্ছন্দ সকলে। পুরভোটের আগে বসিরহাটের বেশ কয়েক জন বধূ জানালেন তাঁদের চাহিদা আর সমস্যার কথা।
সকাল ৮টা। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের ভবানীপুরে গিয়ে দেখা মিলল কাজল গুহর। শুরুতেই এক রাশ অভিযোগ পানীয় জল নিয়ে— ‘‘বেশির ভাগ দিন পাইপ লাইনে ঠিক মতো জল আসে না। এক-এক দিন তো জলই পড়ে না। এক বালতি জল ভরতে হাপিত্যেশ করে থাকতে হয়। অনেক জায়গায় দেখি, পাইপ ফেটে জল বেরোচ্ছে রাস্তায়। ফলে জলের লাইনে নোংরাও ঢোকে। সেই জল খেয়ে পেট খারাপে ভুগতে হয়। না হলে জল কিনে খেতে হয়। সেই সাধ্য তো সকলের নেই।’’
কাজলদেবী আক্ষেপ, এত দিনেও বাড়ি-বাড়ি আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জলের লাইন পৌঁছে দিতে না পারাটা চোখে লাগে। ফুটপাথ বেদখল হয়ে যাওয়া নিয়েও ক্ষোভ আছে তাঁর। জানালেন, একে তো বসিরহাটের রাস্তাঘাট বেশ সরু। সীমান্ত বাণিজ্যের বড়-বড় গাড়িও যাতায়াত করে। ফুটপাথ দিয়ে শান্তিতে হাঁটার উপায় নেই। কোথাও ইমারতি মালপত্র ফেলে, কোথাও গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে দখল হচ্ছে ফুটপাথ। দোকানের সামনের অংশ বাড়িয়ে নিয়েও অনেকে ফুটপাথ দখল করছেন বলে নজরে এসেছে তাঁর। রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় যানজটও হয়। ছেলেমেয়েরা বাইরে বেরোলে বাড়ির লোক চিন্তায় থাকে। এ ছাড়া, শহরে বেশ কিছু ডাস্টবিন রাখা দরকার বলেও মনে করেন তিনি। তাতে অন্তত কিছু নাগরিকের শহরের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে সচেতনতা বাড়বে বলে তাঁর আশা। বসিরহাট থেকে কলকাতা পর্যন্ত সরাসরি বাস বহু দিন ধরে বন্ধ। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি জরুরি, বলছেন কাজল।
১৬ নম্বর ওয়ার্ডের হরিশপুরের বাসিন্দা রানু সিংহ আবার মনে করেন, ‘‘রাস্তাঘাট আগের থেকে ভাল হয়েছে। পানীয় জলেরও উন্নতি চোখে পড়ে। কিন্তু আর্সেনিক-মুক্ত জল খুবই দরকার।’’ এই শহরের আশপাশে আর্সেনিকের সমস্যা দীর্ঘ দিনের। রানুদেবী বলেন, ‘‘ইদানীং শহরের মধ্যেও তা ঢুকে পড়েছে। শহরবাসীর মধ্যেও আর্সেনিকের প্রকোপ লক্ষ করা যাচ্ছে।’’ নিকাশি আরও ভাল করা দরকার বলেও মনে করেন তিনি। বৃষ্টি হলে শহরের বিভিন্ন এলাকায় জল জমছে এখনও। পুর এলাকায় মেয়েদের স্কুল চালু করা দরকার বলেও মনে করেন তিনি।
১৮ নম্বর ওয়ার্ডের ভ্যাবলা স্টেশনের কাছেই থাকেন সবিতা মণ্ডল। পাড়ার কল থেকে স্নান সেরে ফিরছিলেন। শহরের উন্নয়ন নিয়ে কথা উঠতেই বেরিয়ে এল ক্ষোভ— ‘‘এলাকায় গভীর নলকূপ না থাকায় বহু দূর থেকে জল আনতে যেতে হয়। আর্সেনিকের ভয়ে অনেকেই জল কিনে খেতে বাধ্য হন। কিন্তু যাঁদের সেই সাধ্য নেই, তাঁদের বহু দূর থেকে লাইন দিয়ে জল আনতে হয়।’’ ভ্যাবলা স্টেশনের কাছে রেললাইনের উপরে ওভারব্রিজ না থাকায় শহরে যানজট বাড়ছে বলেও তাঁর আক্ষেপ। কেননা তাতে একে সময় নষ্ট হয়, দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বাড়ে। ক্রমবর্ধমান দুষ্কৃতী-দৌরাত্ম্য নিয়েও তিনি উদ্বিগ্ন। কিছু দিন আগেই তাঁর পাড়ার এক বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। তবে সে বার সাহসী এক বধূ ডাকাতের হাত থেকে লোহার রড কেড়ে নিয়ে রুখে দাঁড়ানোয় বড়সড় অঘটন ঘটেনি। সবিতাদেবীর কথায়, ‘‘স্বামী যখন বাড়িতে থাকেন না, ছোট সন্তানকে নিয়ে থাকতে বেশ ভয়-ভয়ই করে। দরজা-জানলা এঁটে রাখি অনেক সময়ে।’’ নুরজাহান মণ্ডল থাকেন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম দন্ডিরহাটে। তিনিও লাইন দিয়ে পাড়ার কল থেকে জল আনতে এসেছিলেন। এলাকায় তেমন কোনও উন্নয়ন হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন তিনি। মিনুদেবীর কথায়, ‘‘বাড়ি-বাড়ি পানীয় জলের ব্যবস্থা এখনও হল না। মাসে ৮০০-১০০০ টাকা শুধু জল কিনে খেতেই লাগে।’’ তাঁর মতে, বড় রাস্তাগুলি অনেকটা ভাল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে এখনও রাস্তা ভাঙাচোরাই রয়ে গিয়েছে।’’ ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আমতলায় থাকেন মিনু ব্রহ্ম। তাঁর মতে, ‘‘রাস্তা বা জলের কাজ কিছু কিছু হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু কোনওটাই ভাল ভাবে হচ্ছে না। পিচ পড়লেও কিছু দিনের মধ্যে সে সব উঠে গিয়ে রাস্তা খারাপ। রাস্তার পোস্টে আলো লাগানো হলেও দু’দিন ছাড়া ছাড়া বাল্ব কেটে গিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাড়ি বাড়ি পানীয় জলের কল এখনও বসল না। অনেকে বিপিএল কার্ড পাননি।’’ মহিলাদের নিরাপত্তা চেয়েও রীতিমতো সরব তিনি।
এঁদের এবং এঁদের মতো অনেকের ভাল লাগা, মন্দ লাগার উপরেই কিন্তু অনেকের ভাগ্য নির্ভর করছে।