বেহাল পরিকাঠামোর মধ্যেই চলছে পরিষেবা। নিজস্ব চিত্র।
আনাজ বলতে শুধুই আলু। তাও ছোট ছোট টুকরো করা। সয়াবিন বা অন্য তরকারি মেলে না বললেই চলে। তবে গোটা ডিম মিলছে। পুষ্টি বলতে ওটুকুই যা ভরসা। এমনই পরিস্থিতি ডায়মন্ড হারবারের বেশিরভাগ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির।
করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল-কলেজের মতো বন্ধ ছিল অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিও। ওই সময় রান্না করা খাবারের বদলে উপভোক্তাদের শুকনো খাবার বিলি করা হয়েছে। সম্প্রতি ফের চালু হয়েছে কেন্দ্রগুলি। অভিযোগ, উপভোক্তাদরে মাথাপিছু বরাদ্দের পরিমাণ একই আছে। অথচ এই দু’বছরে আনাজ-সহ অন্যান্য জিনিসের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। ফলে, সরকারি নির্দেশমতো পুষ্টিকর খাবার দিতে হিমশিম খাচ্ছেন অঙ্গনওয়াড়ির কর্মীরা।
যেমন, মন্দিরবাজার ব্লকের নিশাপুর পঞ্চায়েত আন্দামান উত্তর ঝাঁপবেড়িয়া অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রটির কথাই ধরা যাক। কেন্দ্রটি রয়েছে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গরিব এলাকায়। ওই কেন্দ্রে অন্তঃসত্ত্বা, প্রসূতি ও শিশু মিলিয়ে প্রায় ১৮০জন পরিষেবা নিতে আসেন। মূল্যবৃদ্ধির চাপে বর্তমানে নিয়মমাফিক পুষ্টিকর খাবার জোগান দিতে সমস্যায় পড়েছেন কর্মীরা।
ওই কেন্দ্রের সহায়িকা তপতী সাহা জানালেন, আলুর দাম বেড়ে ২৬ টাকা কিলো হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য সরঞ্জামেরও দাম বেড়েছে। আগে সাদা ভাতের সঙ্গে আলাদা তরকারি রান্না করে দেওয়া হত। এখন ভাতের মধ্যে আলু কুচি কুচি করে ভাত-আনাজ করা হচ্ছে। আগে খিচুড়ির সঙ্গে নানারকমের আনাজ দেওয়া হত। তাও বন্ধ করে দিতে হয়েছে। স্বভাবতই খাবারের গুণগতমান অনেক কমে গিয়েছে। তিনি আরও জানান, গরিব এলাকা হওয়ায় সকলেই প্রতিদিন পরিষেবা নিতে আসেন। প্রত্যন্ত এলাকার এই কেন্দ্রের খাবারের মান নিয়ে কটূ কথা শোনাচ্ছেন উপভোক্তারা।
অঙ্গনওয়াড়ির এক শিশুর অভিভাবক বলেন, ‘‘আগে খিচুড়ি বা সাদা ভাতের সঙ্গে নানা রকমের আনাজ, তরকারি থাকত। ছোটরা তা খেতে পছন্দ করত। কিন্তু এখন তা দেওয়া হচ্ছে না।
আর এক প্রসূতি মায়ের অভিযোগ, ‘‘খাবারের গুণগত মান অনেক কমে গিয়েছে। মাঝেমাঝে এমন খাবার দেয় যে খেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু আমাদের অভাবের সংসার। তাই এখানে যা দেয় তাই খেতে হয়। আর কোনও উপায় নেই।’’
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের অধীনে রয়েছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি। গ্রামীণ এলাকায় অপুষ্টি দূর করতে এবং স্কুলছুট কমাতে এই প্রকল্প চালু হয়েছিল। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ সাহায্যে চলা প্রকল্পটির মাধ্যমে করতে শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতি মায়েদের নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, সোম, বুধ, শুক্রবার আনাজ-ভাত এবং মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনিবার খিচুড়ি-আনাজ দেওয়ার কথা। সেই সঙ্গে সোম থেকে শনি একটা করে গোটা সিদ্ধ ডিম বরাদ্দ থাকে। অথচ অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতিদের জন্য ৬ দিনে মাথাপিছু সরকারি বরাদ্দ ৩ টাকা ৬০ পয়সা। শিশুদের জন্য বরাদ্দ ২ টাকা ১০ পয়সা। তবে এর মধ্যে চাল, ডাল, তেল, লবণ ব্লক প্রশাসন থেকে পাঠানো হয়। পাশাপাশি ডিমের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৫ টাকা ৯০ পয়সা। কিন্তু বাকি আলু, সয়াবিন, লঙ্কা, হলুদ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের বাজার থেকে কিনতে হয়। বর্তমানে আনাজ-সহ সমস্ত মুদি মশলার দাম বেড়ে যাওয়ায় গোটা সিদ্ধ ডিম ঠিকঠাক দিতে পারলেও বাকি মেনুতে কাটছাঁট করতে হচ্ছে অঙ্গনওয়াড়িগুলিতে।
মন্দিরবাজার ব্লকের জগদীশপুর অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের পরিস্থিতি একইরকম। এখানকার কর্মী প্রতিমা পুরকাইত বলেন, ‘‘বাজারদর আকাশছোঁয়া। কী করে এত কম পয়সায় পুষ্টিকর খাবার দিতে পারব? কোনওভাবেই চালিয়ে নিচ্ছি।’’
ওই কেন্দ্রের উপভোক্তা এক শিশুর অভিভাবক শঙ্কর তাঁতি অভিযোগ জানিয়ে বলেন, আমার দুই মেয়ে ওই কেন্দ্রে যায়। আগে যে মানের খাবার দেওয়া হত, এখন তা আর দেওয়া হয় না। একই অভিযোগ জানিয়েছেন অভিভাবক তুলসী হালদার, প্রিয়া পুরকাইতেরা।
মগরাহাট-২ ব্লকের একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রর কর্মী বলেন, ‘‘ভাত-আনাজ দেওয়ার কথা থাকলেও ভাতের মধ্যে কোনওরকমে আলু কুচি কুচি করে দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে খিচুড়ি করা হচ্ছে। অন্য আনাজ দিতে পারছি না বললেই চলে। তা ছাড়া আলুর দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি গরমের কারণে বস্তা বোঝাই আলু থেকে পচা আলু মিলছে। এমনকী, অনেকদিন ডিম পচে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আরও সমস্যা তৈরি হচ্ছে।’’
এ বিষয়ে জেলার প্রোগ্রাম অফিসার অমিত সমাদ্দার বলেন, ‘‘বরাদ্দের টাকা নির্ণয় করে কেন্দ্রীয় সরকার। ফলে আপাতত ওই টাকাতেই পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে।’’