মাথা গোঁজা: পোড়া বস্তির বাসিন্দাদের জন্য তৈরি করে দেওয়া হয়েছে এই ত্রাণ শিবির। ছবি: সুমন বল্লভ।
মাত্র দেড় ঘণ্টার আগুন। আর তাতেই এক দশকেরও বেশি সময়ের বাসস্থান পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। রাতারাতি যেন খোলা আকাশের নীচে নেমে এসেছেন বাসিন্দারা। মাথার উপরে এখন শুধুই ত্রাণ শিবিরের পলিথিনের ছাউনি। পরনের পোশাকটুকুর জন্যও অন্যের উপরে নির্ভর করতে হচ্ছে আনন্দপুরের শ্রমিকপল্লির বাসিন্দাদের।
ই এম বাইপাসের অদূরে ওই বস্তিতে রবিবার সকালের ভয়াবহ আগুনে ৩৮টি ঘর ভষ্মীভূত হয়ে যায়। প্রশাসনের তরফে ১৩৪ জন বাসিন্দার জন্য বস্তির উল্টো দিকে একটি সরকারি জমিতে ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে আশ্রয় শিবির তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়ার শোকে রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি তাঁদের কেউ। সোমবার সকাল হতে না হতে মানুষজন ভিড় জমিয়েছেন ধ্বংসস্তূপে, যদি শেষ সম্বল কিছু বেঁচে গিয়ে থাকে, সেই আশায়।
বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করা লক্ষ্মী মণ্ডল আশ্রয় শিবিরের বাইরে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে মাটিতে মিশে যাওয়া ঘরের দিকে চেয়ে কাঁদছিলেন অনিতা রানাও। লক্ষ্মীর কথায়, ‘‘এই অবস্থায় রাতে কি ঘুম আসে? যত বার ভাবছি, তত বারই মনে হচ্ছে কিছুই তো বাঁচেনি। বিকট শব্দে সিলিন্ডার ফাটছিল। বাচ্চাগুলোর এখনও ভয় কাটেনি, রাতে ঘুমের ঘোরে ওরা ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিল।’’ ত্রাণ শিবিরে বাবা তাপস দুয়ারির হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছ’বছরের সায়ন্তিকা বলে, ‘‘রাতে খুব ভয় লাগছিল। কী জোরে সিলিন্ডার ফাটল। এখন আর ভয় করছে না।’’ সিলিন্ডার ফাটার সেই বিকট আওয়াজ এখনও ভুলতে পারেনি একাদশ শ্রেণির ছাত্র অজিত রানাও। তার কথায়, ‘‘সকালে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। ধোঁয়া দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, আগুন লেগেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খেয়াল করি, মোবাইলটা ফেলে এসেছি। তা আনতে ফের ঘরের দিকে দু’পা এগোতেই চোখের সামনে দেখলাম, আমাদের ঘরের সিলিন্ডারটা ফেটে গেল। রাতে ত্রাণ শিবিরে কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলাম না। সিলিন্ডার ফাটার শব্দটা যেন কানে বাজছিল।’’
বাসিন্দারা জানান, স্থানীয় পুর প্রশাসনের তরফে বস্তির ঠিক উল্টো দিকে একটি ফাঁকা জায়গায় ত্রাণশিবির তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। তবে পোশাক বা গায়ে চাপা দেওয়ার মতো কাপড় তাঁদের কারও কিছু ছিল না। যে কারণে রাতে ঠান্ডায় কষ্টও পেয়েছেন অনেকে। খেতে হয়েছে মশার কামড়ও। মহিলারা জানান, শৌচাগারগুলিও সব ভেঙে গিয়েছে। এ দিন সকাল থেকে প্রাকৃতিক কাজ সারার জায়গাটুকুও পাওয়া যায়নি। ওই বস্তির বাসিন্দাদের জন্য আপাতত ত্রাণ শিবিরের পাশে শৌচাগার তৈরির কাজ শুরু হয় এ দিন সকাল থেকে। পুর প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, যত দিন বস্তির বাসিন্দাদের জন্য ঘর তৈরি করা না হচ্ছে, তত দিন তাঁরা ওই অস্থায়ী শিবিরে থাকবেন। সেই কারণে সেখানে শৌচাগার তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে।
এ দিন আনন্দপুরের ওই বস্তিতে গিয়ে দেখা গেল, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কোথাও পড়ে লোহার খাটের পুড়ে যাওয়া কাঠামো, কোথাও পড়ে আধপোড়া আলমারি, স্টিলের আলনা। দেখলেই বোঝা যায়, বস্তিবাসীদের কারও না কারও ঘর ছিল ওই জায়গাগুলিতে। ঝাড়খণ্ডের গিরিডির বাসিন্দা অনিতা সে দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘‘পুরো জায়গাটা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফাঁকা জমিতে পরিণত হয়ে গিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে না, কে কোথায় থাকতাম। গিরিডির বাড়িতে কিছু কাজের জন্য খানিকটা টাকা জমিয়েছিলাম। সব পুড়ে গিয়েছে।
সব শেষ।’’
তবে কী কারণে আগুন, তা সোমবার পর্যন্ত স্পষ্ট হয়নি। রবিবার ঘটনাস্থলে গিয়েছিল রাজ্য ফরেন্সিক বিভাগ। সূত্রের খবর, এখনও আগুনের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। রবিবার ওই জায়গায় দমকল ও অন্যান্যদের পা পড়ার কারণে ফরেন্সিক তার কাজ ঠিকমতো করতে পারেনি। যে কারণে আবারও ফরেন্সিক ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাবে বলেই খবর।