চরঘেরিতে নির্বিচারে কাটা হয়েছে ম্যানগ্রোভ। নিজস্ব চিত্র।
সুন্দরবন জুড়ে প্রতিবারের মতোই শুক্রবার সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে পালিত হল ‘আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস’। কিন্তু দুর্যোগ মোকাবিলায় এই ‘প্রাকৃতিক ঢাল’ রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা পরিবেশবিদরা বারবার স্মরণ করালেও ম্যানগ্রোভ নিধনে ভাটা পড়েনি এ তল্লাটে। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে ম্য়ানগ্রোভ পরিচর্যা নিয়েও।
পরিবেশবিদদের দাবি, কিছু বেসরকারি সংস্থা সারা বছর ধরেই ম্যানগ্রোভ রোপণের কর্মসূচি নেয়। কিন্তু তার পরিচর্যা একেবারেই করা হয় না। এমনকি, সরকারি উদ্যোগে রোপণ করা গাছও অনেক ক্ষেত্রেই পরিচর্যার অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। তবে, সবচেয়ে বেশি ম্যানগ্রোভ নষ্ট হচ্ছে মাছের ভেড়ি তৈরির জন্য। নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে ভেড়ি তৈরির প্রতিবাদ জানিয়ে বাসন্তীর বাসিন্দা কালাম পৈলান হাই কোর্টের গ্রিন বেঞ্চের দ্বারস্থ হয়েছেন বার বার। ম্যানগ্রোভ কাটা বন্ধ করতে প্রশাসনিক উদ্যোগের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তার পরেও বন্ধ হয়নি ম্যানগ্রোভ নিধন।
সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী বঙ্কিম হাজরা বলেন, ‘‘সুন্দরবন জুড়ে শুধু ম্যানগ্রোভ লাগালে হবে না। তা রক্ষা করার জন্য সুন্দরবনের মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। না হলে আগামী দিনে সুন্দরবন থাকবে না।’’
বন দফতরের হিসাব অনুযায়ী, উত্তর ও দক্ষিণ দুই ২৪ পরগনা মিলিয়ে এ দেশে সুন্দরবন রয়েছে ৪২৬০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে। আর এই এলাকায় সুন্দরী, গড়ান, গেওয়া, বাইনের মতো প্রায় ১০০টি প্রজাতির গাছ জন্মায়। এর মধ্যে ২৮টি প্রকৃত ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ বলেই দাবি উদ্ভিদবিদদের। সুন্দরবন গবেষক দেবব্রত মণ্ডল বলেন, “এই ম্যানগ্রোভই আমাদের ফুসফুস। আর আমরাই এদের অবহেলা করছি। নির্বিচারে কেটে ফেলছি। সকলে মিলে ম্যানগ্রোভকে রক্ষা করতে হবে। গ্রামের মানুষকে নিয়ে তৈরি করতে হবে এই রক্ষাকবচ।”
গোসাবার সোনাগাঁ, চরঘেরি ও কুমিরমারি এলাকায় নদীর চরে ম্যানগ্রোভ রোপণ করে শিক্ষক উমাশঙ্কর মণ্ডল বলেন, “কয়েক বছর ধরে সুন্দরবন এলাকায় প্রায় ১০ লক্ষ ম্যানগ্রোভ রোপণ করেছি গ্রামের মানুষ, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সহযোগিতায়। এই ম্যানগ্রোভ দিবস উপলক্ষেও গোসাবার তিনটি দ্বীপে ১০ হাজার গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। আমরা গ্রামে গ্রামে ‘ম্যানগ্রোভ আর্মি’ তৈরি করেছি রোপণ ও তার পরিচর্যার জন্য। কিন্তু কিছু অসৎ মানুষ রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ কেটে ফেলছে।’’
দক্ষিণ ২৪ পরগনা বন বিভাগের উদ্যোগে শুক্রবার ‘ম্যানগ্রোভ দিবস’ পালিত হল পাথরপ্রতিমার আনন্দলাল আদর্শ বিদ্যালয়ে। একটি সচেতনতামূলক পদযাত্রায় বার্তা দেওয়া হয়, ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের। তা হলেই বাঁচবে সুন্দরবন। নদীবাঁধ ভাঙন রোধ করা যাবে। পাথরপ্রতিমা ব্লকে ১০ লক্ষ ম্যানগ্রোভ লাগানোর কর্মসূচি নেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী, জেলা সভাধিপতি নীলিমা মিস্ত্রি, বিধায়ক সমীরকুমার জানা প্রমুখ। ক্যানিংয়ে জুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র তরফে যেমন দিনটি উদযাপিত হয়, তেমনই ক্যানিং থানার উদ্যোগেও মাতলা নদীর চরে ম্যানগ্রোভ রোপণ করা হয়। ক্যানিংয়ের আইসি সৌগত ঘোষ জানান, ম্যানগ্রোভ রক্ষায় মধুখালি, গোলাবাড়ি এলাকায় মহিলারা দায়িত্ব নিয়েছেন। কেউ গাছের ক্ষতি করলে তৎক্ষণাৎ পুলিশকে ফোনে জানানো হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হিঙ্গলগঞ্জের নেবুখালি এবং সন্দেশখালির বেড়মজুরেও ম্যানগ্রোভ চারা রোপণ করা হয় দু’টি সংগঠনের তরফে।