অসুরক্ষিত: এই ধরনের ‘ভি’ মডেলের ট্রলারে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেশি বলে মত মৎস্যজীবীদের একাংশের। ফাইল চিত্র।
ফি বছর ইলিশের মরসুমে গভীর সমুদ্রে যাওয়া ট্রলার মাছ ধরে ফেরার পথে দুর্ঘটনার মুখে পড়ছে। বহু প্রাণহানি ঘটছে। ক’দিন আগেই চরে ধাক্কা খেয়ে ট্রলার উল্টে মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের। দুর্ঘটনার পিছনে নজরদারি ও পরিকাঠামোর অভাবকেই দায়ী করছে মৎস্যজীবী সংগঠন। সেই সঙ্গে মৎস্যজীবীদের কিছু গাফিলতির কথাও উঠে আসছে।
ইলিশের মরসুমে সুন্দরবন এলাকায় প্রায় ১০-১১ হাজার ট্রলার গভীর সমুদ্রে যায়। কিছু ট্রলার বেশি মাছ পাওয়ার আশায় বাংলাদেশের দিকে চলে যায়। আবহাওয়া খারাপ হলে রেডিয়ো মারফত তারা সময় মতো খবর পায় না বলে জানা যাচ্ছে। পরে জানতে পেরে তড়িঘড়ি ফিরতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানাচ্ছে মৎস্যজীবীদের সংগঠন। দু’বছর আগে প্রায় ৪০টি ট্রলার বাংলাদেশের দিকে চলে গিয়েছিল। তারা ফেরার সময়ে দুর্ঘটনায় পড়ে।
বাংলাদেশে ছোট মাছ ধরা কঠোর ভাবে নিষেধ থাকায় ছোট মাছ ধরার জন্য ট্রলি জাল ব্যবহার করে বাংলাদেশের কাছাকাছি চলে যান এ দিকের অনেক মৎস্যজীবী। ট্রলি জাল ব্যবহার করা ভারতেও নিষিদ্ধ। তবে চোরাগোপ্তা ভাবে ওই জালে মাছ ধরা চলছে। এ বারও কিছু দিন আগে বেশ কিছু ছোট ইলিশ বোঝাই ট্রাক বাজেয়াপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের দিকে গিয়ে ইঞ্জিন বিকল হলে বা জলোচ্ছ্বাসের কারণে দাঁড়িয়ে গেলে ভারতীয় কোনও ট্রলার উদ্ধার করতে যায় না। এ ছাড়া, মাঝসমুদ্রে আবহাওয়া খারাপ হলে দ্রুত সমুদ্র-লাগোয়া খাঁড়ি জম্বুদ্বীপ, কেঁদোদ্বীপ বা সাগরের দিকে আসার সময়ে দুর্ঘটনা ঘটে। ওই দ্বীপ এলাকার সমুদ্র বা নদীর মোহনার মুখে চর পড়ে যাওয়ায় গভীরতা কম। সে ক্ষেত্রে জলোচ্ছ্বাস হলে বড় ঢেউয়ের নীচের গভীরতা মাপা যন্ত্র (ফিস ফাইন্ডার) কাজ করে না। ফলে চরে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটে।
এ ছাড়া, অদক্ষ মাঝিদের জন্যও ঘটছে বলে অভিযোগ মৎস্যজীবী সংগঠনের অনেকের। এক বছর নৌকো বা ভুটভুটি চালিয়েই কেউ হয় তো পরের বছর ট্রলারে সহকারী মাঝি হয়ে পাড়ি দিচ্ছেন গভীর সমুদ্রে। তারপরের বছর হয় তো তিনিই মূল মাঝি। অনভিজ্ঞতার কারণে বিপদ মোকাবিলা করা তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়ে ওঠে।
মৎস্যজীবীদের প্রাণহানির পিছনে লাইফ জ্যাকেট পরার অনীহা আরও একটি বড় কারণ বলে জানাচ্ছেন অনেকেই। মাছ ধরে ফেরার পথে মৎস্যজীবীরা লাইফ জ্যাকেট পরছেন কিনা, তা নিয়ে মৎস্য দফতরের কোনও নজরদারি নেই। যাঁরা জ্যাকেট ব্যবহার করবেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার আছে বলে মনে করেন অনেকে। কিন্ত গভীর সমুদ্রে গিয়ে নজরদারির মতো পরিকাঠামো নেই দফতরের।
পূর্ব মেদিনীপুর বা অন্ধপ্রদেশ, কেরলে ট্রলারের আকৃতি ‘ইউ’ মডেলের। তা তুলনায় বেশি সুরক্ষিত। কিন্ত সুন্দরবন এলাকার সমস্ত ট্রলার ‘ভি’ মডেলের হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটছে বলেও অভিযোগ মৎস্যজীবীদের অনেকের। ট্রলার তৈরির ক্ষেত্রেও বছরের পর বছর ধরে কোনও নিয়ম নেই। বহু বছর ধরে মালিকেরা একই মডেলের ট্রলার তৈরি করে আসছেন।
কাকদ্বীপ মৎস্যজীবী ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বিজন মাইতি বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার পিছনে মৎস্যজীবীরা কিছুটা দায়ী। কারণ বেশি মাছ পাওয়ার লোভে অনিচ্ছাকৃত ভাবে হলেও তাঁরা বাংলাদেশের দিকে চলে যাচ্ছেন। কোনও দুর্যোগ হলে তড়িঘড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।’’ ‘ভি’ মডেলের ট্রলারও দুর্ঘটনার কারণ বলে মনে করেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘ট্রলারের মডেলের পরিবর্তনের জন্য একাধিকবার বিষয়টি মৎস্য দফতরের সভায় তুলেছি। কিন্ত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’’
‘ভি’ মডেলের ট্রলারের সামনের দিকটি তিন কোণা। অন্য দিকে, ‘ইউ’ মডেলের ট্রলারের সামনের দিক তুলনায় গোলাকৃতি। তিন কোণা মডেলের ট্রলার চরে আঘাত লাগার আশঙ্কা বেশি থাকে বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা সহ মৎস্য অধিকর্তা (সামুদ্রিক) জয়ন্তকুমার প্রধান। তিনি আরও বলেন, ‘‘নদী বা সমুদ্রে চর পড়ে গিয়ে নাব্যতা কমে যাওয়ায় ট্রলার দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া, বেশি মাছ নিয়ে ফেরার সময়ে ট্রলার নীচের অংশ বসে গিয়ে চরে ধাক্কা খাচ্ছে। আর জ্যাকেট পরার বিষয়ে প্রতিটি শিবিরে মৎস্যজীবীদের বলা হয়।’’ মৎস্যজীবীদের সংগঠনগুলি এ বিষয়ে নজর দিলে ভাল হয় বলে তাঁর মত।