ভিড়: টিকা নেওয়ার এমনই দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন কেন্দ্রে। নির্মল বসু।
টিকার লাইনে ধাক্কাধাক্কি, হুড়োহুড়ির মধ্যে পড়ে পদপিষ্ট হলেন কয়েকজন। মঙ্গলবার ভোরে উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালির কালীনগরের এই ঘটনায় এক মহিলাকে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অল্পবিস্তর জখম হয়েছেন আরও জনা দশেক পুরুষ-মহিলা।
প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া ক’দিন বন্ধ থাকার পরে ফের চালু হয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার কোথাও কোথাও। এই পরিস্থিতিতে ভিড় বাড়ছে সে সব জায়গায়। অভিযোগ, লাইন নিয়ন্ত্রণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করে উঠতে পারছে না পুলিশ-প্রশাসন, স্বাস্থ্য দফতর। ঘটছে নানা দুর্ঘটনা।
বসিরহাট স্বাস্থ্য জেলার আধিকারিক দেবব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কতজনকে টিকা দেওয়া হবে, তা আগে থাকতে জানানো সত্ত্বেও অযথা ভিড় করায় নানা জায়গায় বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটছে। ধাক্কাধাক্কিতে মানুষের চোট লাগছে। এটা কাম্য নয়।’’
কালীনগর গ্রামীণ হাসপাতালে মঙ্গলবার ৫৫০ জনকে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হবে বলে সোমবার বিকেলে নোটিস দেওয়া হয়। সকাল ৬টার পরে যাঁরা লাইন দেবেন, তাঁদের ৮টার পরে টোকেন পাওয়ার কথা। সোমবার রাত থেকেই হাসপাতালের বাইরে রাস্তার উপরে লাইন দেন কয়েকশো মানুষ। ভোরের দিকে একদল মানুষ লাইনের প্রথমে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে শুরু হয় হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি।
সন্দেশখালির বাসিন্দা পরিতোষ মৃধা, স্বপন মণ্ডল, রত্না দাসদের কথায়, টিকা নেওয়ার জন্য হাসপাতালের বাইরে মশারি টাঙিয়ে রাতে ছিলাম। কিন্তু সকাল থেকেই লাইন ভেঙে ঠেলাঠেলি করে হাসপাতালের মধ্যে বহু মানুষ ঢুকে পড়ে। পুলিশ আসে। কিন্তু তারাও পরিস্থিতি ঠিক মতো সামাল দিতে পারেনি। এ দিন অব্যবস্থার মধ্যে শেষমেশ টিকা নিতে পারেননি বলে জানালেন পরিতোষ, স্বপনরা।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, এ দিনের ঘটনা। পদপিষ্ট হয়েছেন ৩ মহিলা এবং ৮ জন পুরুষ। বছর পঞ্চাশের কণিকা মল্লিককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কালীনগর গ্রামীণ হাসপাতালের স্বাস্থ্য আধিকারিক দেবব্রত বিশ্বাস বলেন, ‘‘শুনেছি ভোরবেলায় হুড়োহুড়ির মধ্যে রাস্তায় পড়ে গিয়ে এক মহিলা গুরুতর আহত হয়েছেন।’’ তাঁর পরামর্শ, ‘‘রাত জেগে কেউ লাইনে দাঁড়াবেন না। সকাল ৬টার সময়ে হাসপাতালে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে টোকেন নিয়ে সুষ্ঠু ভাবে টিকা নেবেন।’’
কিন্তু স্বাস্থ্যকর্তাদের এমন পরামর্শে কাজ হচ্ছে না বিশেষ। নানা জায়গা থেকেই টিকার লাইনে হুড়োহুড়ির খবর আসছে। বিশেষত, প্রথম ডোজের টিকা নিয়মিত না দেওয়ার ফলে যখনই মানুষ শুনছেন, প্রথম ডোজ দেওয়া হবে, তখনই ভিড়, হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি বাড়ছে। রোদ-গরম-বৃষ্টি মাথায় লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। বিভিন্ন হাসপাতালের বাইরে কিছু লোক টাকার বিনিময়ে লাইন রাখছে বলেও অভিযোগ উঠছে। টিকাকরণ নিয়ে কোথাও কোথাও শাসকদলের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণের অভিযোগ তুলছে বিরোধীরা। রাতে যে সব মহিলারা হাসপাতাল চত্বরে থেকে লাইন দিচ্ছেন, তাঁদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
মিনাখাঁ, সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জ-সহ বসিরহাট মহকুমার বিভিন্ন হাসপাতালের সামনে রাত জেগে লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকে টিকা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। বুধবার কাকলি মুন্ডা, প্রেয়সী সর্দার, বাবলু সর্দাররা জানালেন, হাড়োয়ার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে তাঁদের মতো বহু দরিদ্র আদিবাসী পুরুষ-মহিলা টিকা নিতে আসছেন। যাতায়াতে খরচও হচ্ছে অনেকের। কিন্তু বার বার ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও মিলছে না টিকা।
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বসিরহাট লোকসভার ২৭ লক্ষ মানুষের জন্য এখনও পর্যন্ত টিকা এসেছে ৭ লক্ষের মতো। ১১টি হাসপাতাল এবং ৩টি পুরসভা থেকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। ফলে কেন্দ্রগুলিতে ভিড় বাড়ছে। সেখানে দূরত্ববিধিও বজায় থাকছে না।
সোমবার মিনাখাঁ ব্লক হাসপাতালেও টিকার লাইনে হুড়োহুড়ি হয়েছে। জখম হন দুই মহিলা। আড়াইশোজনকে টিকা দেওয়া হবে বলে আগে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রবিবার সন্ধ্যা থেকে ভিড় জমতে শুরু করে হাসপাতালের বাইরে। সকালের দিকে ভিড় আরও বাড়ে। পুলিশ গেট খুলে দিতেই হুড়মুড়িয়ে হাসপাতালের ভিতরে ঢুকে পড়েন কয়েকশো মানুষ। তাদের কুপন দিয়ে টিকা দেওয়ার কাজ শুরু হতেই তৈরি হয় আরও এক দফা বিশৃঙ্খলা। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই মহিলা ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান।
পরিস্থিতি যেমন আকার নিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ। বসিরহাট পুলিশ জেলার এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘যে যে শিবির থেকে টিকা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে সিভিক ভলান্টিয়ার রাখা হয়েছে। তবে তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা মাথায় রেখে টিকা নিতে মানুষ প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।’’ তাঁর কথায়, ‘‘যে কোনও দিন লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।’’