মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের একাংশে খরার পিছনে কলকাঠিটা যে সে-ই নেড়েছে, আবহবিদেরা তার প্রমাণ পেয়েছেন বারবার। এ বার সেই ‘এল নিনো’ বা দুষ্টু ছেলের দাপটেই উষ্ণতম বছরের শিরোপা পেতে চলেছে ২০১৫।
বুধবার জেনিভায় এমনই ঘোষণা করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের শাখা সংগঠন বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও)। ওই সংস্থার আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, এই মুহূর্তে এন নিনোর ভাবগতিক যা, তাতে ২০১৬ সাল আরও কষ্টকর হতে চলেছে। কারণ আগামী বছর বিশ্বের গড় তাপমাত্রা চলতি বছরের রেকর্ডকে ছাপিয়ে যতে পারে।
২০১৫ শেষ হতে আরও ৩৫ দিন বাকি। ডব্লিউএমও-র আশঙ্কা, ওই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১৯৬১ সালের তুলনায় এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডব্লিউএমও-র সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এ বছর পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১৯৬১-’৯০ সালের তুলনায় ০.৭৩ ডিগ্রি বেড়েছে। ১৯৬১ থেকে ’৯০ পর্যন্ত পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ছিল ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জেনিভায় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল মাইকেল জরাড এ দিন আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘পৃথিবীর পক্ষে এটা খুবই খারাপ খবর।’’
পৃথিবী জুড়ে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ প্রশান্ত মহাসাগরে জলস্তরের তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এই প্রাকৃতিক প্রবণতার নামই ‘এল নিনো’। তার দুরন্তপনায় কোথাও খরা তো কোথাও অতিবর্ষণ বা অকালবর্ষণ। কোথাও অসময়ে হাড়-কাঁপানো শীত তো কোথাও শীত কালেও অসহ্য গরম। দিল্লির মৌসম ভবনের আশঙ্কা, এ বার শীতেও তাপমাত্রা খুব একটা কমবে না। কারণ এল নিনো এখন পুরো শক্তিতে রয়েছে। শীতের সময় হয়ে গেলেও পারদ খুব বেশি নামার সম্ভাবনা যে নেই, শেষ নভেম্বরে কলকাতার আবহাওয়া দেখেই তা মালুম হচ্ছে।
এল নিনো কী করতে পারে, অগস্টেই তা বুঝে গিয়েছিলেন মৌসম ভবনের বিজ্ঞানীরা। সেখানকার এক আবহবিদ বলেন, ‘‘এল নিনো যে এ বার ভোগাবে, বছরের গোড়াতেই সেটা বোঝা গিয়েছিল। দেশে স্বাভাবিকের থেকে কম বৃষ্টি হবে বলে ঘোষণা করেছিলাম আমরা। তবে আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া একের পর এক ঘূর্ণিঝড় জুলাই পর্যন্ত ঢেলে বৃষ্টি দিয়েছে দেশের বিভিন্ন অংশে। এল নিনো তখন দাঁত ফোটাতে পারেনি।’’ কিন্তু জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকেই পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারত বাদ দিলে দেশের বাকি অংশে হঠাৎই বৃষ্টি কমে যায়। অনাবৃষ্টির পরিস্থিতি তৈরি হয় মধ্য ভারত ও অন্ধ্রের একাংশে। সেখানে খরা ঘোষণা করতে হয়।
এল নিনো যে-বার সক্রিয় থাকে, সেই সব বছরে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়াই মুশকিল হয়ে যায়। চলতি বছরে বর্ষার পূর্বাভাস দিতে গিয়ে এমনই সমস্যায় পড়েছিলেন মৌসম ভবনের আবহবিদেরা। ডব্লিউএমও এ দিন যে-বিবৃতি প্রকাশ করেছে, তাতে আগামী বছর বর্ষার হাল কী হবে, সেটা ভাবিয়ে তুলেছে তাঁদের।
খাস আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে বৈপরীত্যের খেল্ দেখিয়েছে এল নিনো। গত বছর পশ্চিম আমেরিকার আলাস্কা, আরিজোনা ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো অঞ্চলে তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের থেকে অনেকটাই বেশি। কোনও কোনও জায়গায় স্বাভাবিকের থেকে ১০-১৫ ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। শীতকালটাই প্রায় লোপাট হয়ে যায় ক্যালিফোর্নিয়ায়। প্রবল গরমে জলকষ্ট দেখা দিয়েছিল সেখানকার বিভিন্ন অঞ্চলে। কিন্তু আমেরিকার পূর্ব দিকের ছবিটা ছিল ঠিক তার উল্টো। তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল হিমাঙ্কের নীচে। হাড়-কাঁপানো শীতে কেঁপেছে নিউ ইয়র্ক, বস্টন, ওয়াশিংটন। আবহবিদদের বক্তব্য, পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের আবহাওয়ার এই বৈপরীত্যই বলে দিচ্ছে, উষ্ণায়নের থাবা থেকে এই মেদিনীর রেহাই পাওয়া দূর অস্ত্।
‘এল নিনো’র এই প্রাণান্তকর দুষ্টুমির জন্য মানবসমাজের আচার-আচরণ অনেকটাই দায়ী বলে জানাচ্ছে ডব্লিউএমও। বিভিন্ন দেশে গ্রিন হাউস গ্যাস (কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার, নাইট্রোজেনের গ্যাস) অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পরিবেশে এসে মিশছে। তার প্রভাবে বাড়ছে বাতাসের তাপমাত্রা। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে এল নিনো। এই দুইয়ের যুগলবন্দিতে আবহাওয়া আগামী বছর বিশ্ব জুড়ে বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে আবহবিদদের আশঙ্কা। কোথাও অসময়ে ভারী বৃষ্টির জেরে বন্যা হতে পারে। কোথাও বর্ষার সময়েও বৃষ্টি বিশেষ হবে না। কোথাও গ্রীষ্মে তুষারপাত হতে পারে। কোথাও বা অনুভূত হবে ‘গরম’ শীত অর্থাৎ শীত কালেও গরমই দাপট দেখাবে।
এল নিনো কী
প্রশান্ত মহাসাগরে জলপ্রবাহের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়াই পৃথিবী জুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ। জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সেই ভৌগোলিক-প্রাকৃতিক ঘটনার নাম ‘এল নিনো’। স্প্যানিশ ভাষায় ‘এল নিনো’ মানে ছোট্ট ছেলে। জলস্তরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রাকৃতিক প্রবণতার সঙ্গে বিষয়টি জুড়ে যাওয়ায় ওই শব্দবন্ধের অর্থ দাঁড়িয়ে গিয়েছে ‘দুষ্টু বা দুরন্ত ছেলে’। কারণ তারই দুষ্টুমিতে অনাবৃষ্টি বা খরা, অতিবৃষ্টি কিংবা অকালবৃষ্টিতে নাকাল হতে হয় মানুষকে।