প্রাকৃতিক সৌন্দের্যে ভরা চা বাগানেই গড়ে উঠবে পর্যটন। —ফাইল চিত্র।
চা বাগানে বাড়তি জমি অঢেল। তাই ভাবা হয়েছিল নিরালায়, চা বাগানের মনোরম পরিবেশে পর্যটন কেন্দ্র হলে নির্ঝঞ্ঝাটে কাটানো যাবে কয়েকদিন। থাকবে আধুনিক জীবনের প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই। থাকবে চা বাগানের অচেনা জীবনের স্বাদও।
কিন্তু সে কথা এখনও রাখা যায়নি। অথচ আট মাস আগে চা পর্যটন নীতি চালু হয়েছে রাজ্যে। খুব দ্রুতই চা পর্যটন চালু করার পরিকল্পনা জানানো হয়েছিল। কিন্তু যত পরিমাণ জমিতে পর্যটন কেন্দ্র গড়া যাবে বলে সরকার ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছে, তা পছন্দ হয়নি বাগান মালিকদের অনেকেরই। সেই সঙ্গে চা বাগানের জমিতে নিজেরা না-গড়ে অন্য কাউকে পর্যটন কেন্দ্র গড়তে দিলে বর্তমান বাজার দর মেনে ফের ‘লিজ’ প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক বলেও সরকারি নীতিতে রয়েছে। ওই শর্ত বাগান মালিকদের অপছন্দ। বাগান মালিক ও সরকারের মধ্যে এ হেন মতপার্থক্যের জটে আটকে গিয়েছে চা-পর্যটন গড়ার প্রক্রিয়া।
একনজরে দেখে নেওয়া যাক চা বাগানের মধ্যে ওই পর্যটন কেন্দ্র গড়ার জন্য জমি নিয়ে সরকার কি নির্দেশিকা তৈরি করেছে। সরকারি নীতি অনুযায়ী, চা বাগানের মধ্যে যে জমিতে আবাদ হয় না, এমন পাঁচ একর জমিতে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা। তার মধ্যে সমতলে দেড় একর ও পাহাড়ে এক একরের মধ্যে তৈরি করতে হবে পর্যটকদের থাকার জন্য বাড়ি। বাকি অংশে করা হবে সৌন্দর্যায়ন।
কিন্তু চা বাগান কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, তাঁরা জমি পান ৩০ বছরের লিজে। সেই জমিতে চা উৎপাদন ছাড়া অন্য কোনও ব্যবসায়িক কাজ করার অনুমতি নেই। তবে সরকারের বর্তমান চা পর্যটন নীতি মতো, কোনও চা বাগান কর্তৃপক্ষ নিজের নামেই পর্যটন প্রকল্প সেই চা বাগান এলাকার মধ্যে করতে পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে জমি বাবদ রাজস্ব দিতে হবে বাজারের হার মতো। তবে আরও একটি রাস্তা রয়েছে।
যেমন, যদি চা বাগান কর্তৃপক্ষ নিজেরাই নতুন নামে একটি পর্যটন সংস্থা খুলে অথবা অন্য কোনও সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই পর্যটন ব্যবসায় নামতে চান, তা হলে তাঁদের আগে ওই পাঁচ একর করে জমি সরকারকে ফেরত দিয়ে দিতে হবে। তার পরে নতুন করে বাণিজ্যিক হারে লিজ নিতে হবে। সেলামি ও রাজস্বও নতুন হারে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে পদ্ধতিগত এই জটিলতার কারণেই শিল্পপতিরা চা পর্যটনে আগ্রহী হচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। বেশির ভাগ শিল্পপতিই চান, স্বীকৃত পর্যটন সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়েই কাজ করতে। সেই সঙ্গেই শিল্পপতিরা চান, জমির পরিমাণ বাড়ানো ছাড়াও বাণিজ্যিক হারে রাজস্ব দেওয়ার প্রস্তাবটিও পুনর্বিবেচনা করা হোক।
তবে সরকারের বক্তব্য, চা পর্যটন প্রকল্প পুরোপুরি বাণিজ্যিক। তাই বাগানগুলিকে বাণিজ্যিক হারেই রাজস্ব দিতে হবে। সরকারি সূত্রেই আশঙ্কা করা হয়েছে, জমির ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে না রাখলে পর্যটনের নামে চা বাগানে প্রোমোটারি শুরু হতে পারে। চা বাগান মালিকপক্ষের একাংশ যদি অন্য কারও সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে প্রকল্প করেন, সে ক্ষেত্রে জমি বাবাদ বাজার দর হারে টাকা পাওয়ার সুযোগও তাঁদের থাকবে। কিন্তু ওই টাকা যাতে রাজ্যের কোষাগারে ঢোকে সে জন্যই কড়াকড়ি করা হয়েছে বলে পর্যটন দফতরের এক অফিসার জানান।
এই অবস্থায় জট কাটাতে বাগান মালিকদের সংগঠনগুলির সঙ্গে ফের আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব এবং রাজ্যের পর্যটন মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী। গৌতমবাবু বলেন, “শীঘ্রই বাগান মালিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসা হবে। জেদাজেদি না করে যাতে প্রকল্প দ্রুত হয় সে কথা বাগান মালিকদেরও বুঝতে হবে।” পর্যটন মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুবাবু বলেন, “সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় সমাধান সূত্র খোঁজা হবে।”
টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার ডুয়ার্স শাখার সচিব রণজিৎ দত্ত জানিয়েছেন, তাঁদের বক্তব্য লিখিত ভাবে সরকারকে জানিয়েছেন। নতুন করে আলোচনায় বসারও তাঁরা পক্ষপাতী। আর দার্জিলিং টি অ্যাসোয়িশনের প্রধান উপদেষ্টা সন্দীপ মুখোপাধ্যায় জানান, প্রকল্পের পদ্ধতিগত আরও সরলীকরণ প্রয়োজন। উত্তরবঙ্গের পর্যটন ব্যবসায়ী সম্রাট সান্যাল বলেন, “যত দ্রুত এই ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে, ততই উত্তরবঙ্গের পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ হবে।”
আপাতত ভরসা বলতে সেই আগে চালু হওয়া কয়েকটি বাগানের অতিথি নিবাস। যেগুলি অধিকাংশই চা বাগানের বাংলোকে ভাড়া দিয়ে চলে। ডুয়ার্সের জুরান্তি, কার্শিয়াঙের সেলিম হিল, মকাইবাড়ির মতো হাতে গোনা কয়েকটি বাগান। রাজ্য সরকার যে ভাবে চায়, সেই চা পর্যটন এখনও কোথাও গড়ে উঠছে না। সম্প্রতি একমাত্র বেঙ্গল অম্বুজা কার্শিয়াঙের একটি চা বাগানে সেই প্রকল্প করার কথা ঘোষণা করেছে।