কলকাতা শহর থেকে মাত্র ১৬০ কিমি দূরে নিখাদ একটি গ্রাম। গ্রামটির প্রাচীনত্ব তার শিকড় অনুসন্ধানেই প্রকাশ পাচ্ছে। আনুমানিক দশম-একাদশ খ্রিস্টাব্দে এক জন সামন্ত রাজা এখানে তাঁর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিংবদন্তি, রাজার চেহারার সঙ্গে লোমশ ভাল্লুকের সাদৃশ্য থাকায় তাঁর নাম ছিল ভাল্লুপদ, এবং রাজ্যটির নাম ভাল্কি। রাজা তাঁর প্রজাদের জলকষ্ট নিবারণে রাজ্যে সাড়ে তিনশো পুষ্করিণী খনন করিয়েছিলেন যার মধ্যে একশোটি এখনও প্রাণবন্ত। রাজ্যের সীমান্তে বৃত্তাকারে প্রান্তবাসীদের বসতি গড়ে তিনি রাজ্যটিকে সুরক্ষাবলয়ে মুড়ে দিয়েছিলেন। গ্রামের ভিতরে বসবাস করতেন উচ্চবর্ণের মানুষ। কালের বিবর্তনে সেই লক্ষ্মণ-রেখা অনেকটাই ভেঙেছে। ধর্ম-বর্ণ বিভাজন শিথিল হলেও বিস্ময়কর ভাবে রয়ে গিয়েছে সেই গ্রামটি তার প্রাচীনত্ব নিয়ে। ভাল্কির কথা শুনেছিলাম আউসগ্রাম বনবাংলোয় বসে বিটবাবুর মুখে। তিনি বলেছিলেন, এই তো চার মাইল দূরেই ভাল্কি। চাইলে আজ দুপুরেই হতে পারে।
সেই শীত-দুপুরেই স-বাইক বিটবাবু ও আমি। আউসগ্রাম পেরিয়ে মাইল দেড়ের জঙ্গল ফেলে রাধামোহনপুর, কুমিরখোলা, শ্যামপুর গ্রাম লাফ মেরে ধানের মাঠ। শীতের ফসল কাটা চলছে। মাঠের লগবানের (নবান্ন) বাজনা বাজছে। মাঠ পুজো সেরে ধানের শিস কেটে নিয়ে গাঁয়ের বৌয়েরা চলেছেন ঘরে। নতুন চালের পায়েস রেঁধে সপরিবার গ্রহণ করবেন। ধানের পরেই শ্যালোর জলে আনাজ চাষ। সব্জি চাষে ভাল্কির খ্যাতি আছে। ডান দিকে কলোনিপাড়া রেখে বাঁ দিকে জঙ্গল পেরিয়ে বাইক ঢুকল কাঁচা গ্রামে। মোরাম ঢালা পথের দু’ধারে চুন-সুড়কির ভাঙা ইমারত। পাশেই প্রাচীন বিষ্ণুমন্দির। একই সঙ্গে খড়-টিন ছাউনির মেটে দোতলা বাড়িও পাল্লা দিয়ে চলছে। মানুষগুলি যে এই সময়ের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে, ওঁদের কৌতূহল দেখেই বোঝা গেল। গলিপথ পেরিয়ে বাইক এসে থামল গ্রামের কেন্দ্রস্থলে। সামান্য ক’টি প্রয়োজনীয় দোকান নিয়ে ভাল্কির বাজার পাড়া।
একটি মাত্র চা-পকোড়ার দোকান ঘিরে মানুষের সকাল-বিকেলের মজলিস। বিকেল গড়াতেই দোকানটি সরগড়ম। নতুন মানুষকে পেয়ে তাঁরা সমাদরে বসান। প্রবীণ এক জন বললেন, এই অঞ্চলের রাজা ছিলেন শৈব। এ দিকটা ঘুরলে পাবেন পুরনো শিব আর বিষ্ণুমন্দির। আর কী পাব? আগাম বলব কেন? নিজেরাই ঘুরুন। আর হ্যাঁ, যে কথাটি বলার, তা হল এখানে রাজনীতির ভেদ থাকলেও মানুষের মনে বিভেদ নেই। সব বর্ণ মিলেমিশে গড়ে উঠেছে প্রীতির স্তবক। আমি বলি, সেই বর্ণটি টের পেয়েছি আগেই, আপনার কথায় বর্ণটি পাকা হল। কথার রেশ টেনে পাশের এক ভদ্রলোক বলেন, ১৮ পাড়ার গ্রাম ভাল্কি। এখানে পাবেন অধিকারী পাড়া, বাউরি, বাগদি, ডোম, মেটে, সাঁওতাল, মুসলিম, মিশ্র, অগ্রদানী ইত্যাদি। পাড়াগুলি ভিন্ন হলেও পরব উৎসবে সকলেই অভিন্ন। এই যেমন ঈদ পরবে শেখ রুস্তমের বাড়িতে আমাদের আমন্ত্রণ। শিবরাত্রির মেলায় আমাদের আশ্রমে বসে ওঁরাও পংক্তিভোজ করেন। আবার পৌষ সংক্রান্তি থেকে সাত দিনের বহমান সাহেবের মাজারের বড় মেলায় এক দিনের বিরিয়ানি ভোজে সাম্প্রদায়িক বাঁধন নেই। শীতের ওই সময়টা ভাল্কি গ্রামে পিঠে উৎসব লেগে যায়। ঘরে ঘরে নতুন চালের খাদ্যখানা। কুটুম আপ্যায়নে সাত-দশ কিসিমের পিঠে গড়া হয়। সিস পিঠে, ধুমসো, ধুকি, গুঞ্জা, সাজ পিঠে। বৃদ্ধ বলেন, বছর সতেরো পিছিয়ে দেখলে ভাল্কির দশা ছিল বড় করুণ। চাষাবাদ তো দূর অস্ত। অনুর্বর ডাঙা পড়ে ছিল দিগন্ত জুড়ে, আর তালগাছ। মানুষ তালকে আশ্রয় করে টিকে থাকতেন। তাল রুটি, তাল ফুলুরি, নেচা, পিঠা। সেই সময় এ গ্রামের ছেলেদের জন্য বিয়ের পাত্রী জুটত না। এক জন ব্লক অফিসার এসে ভাল্কির মেজাজই দিলেন বদলে। সজলধারা প্রকল্প চালু হল। পুকুরগুলিতে জল ধরে সুখা মরসুমে কাজে লাগান। গ্রামের উৎসাহী মানুষগুলিও জাত-ধর্ম ভুলে এগিয়ে এলেন। মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি হল। ৩৫৪ হেক্টর জঙ্গলে বাঁধা হল ভাল্কির পরিবেশ। এ বারে ঘুরে দেখুন আমার কথার সত্যাসত্য। তা হলে দেখাই যাক। উঠে বসলাম বাইকে, স্থানীয় ফকির বাউরিকে বাড়তি সওয়ারি করে। সে-ই আমাদের পথ প্রদর্শক।
দক্ষিণে সামান্য গেলেই সজলধারা প্রকল্পের দোতলা গেস্ট হাউস। তার পর সোনাঝুরি শাল সেগুনে ঘেরা দিঘি। সুঁড়ি পথটা পড়ল গিয়ে পিচ পথে। কালো পালিশ পথটি একেবারেই নির্জন। ফকিরের নির্দেশে বাইক চলে পশ্চিমে। ডান দিকে বনসৃজন, বাঁ দিকে আমের বন। তার পাশেই বাঁধানো শ্মশান, ব্যাকগ্রাউন্ডে জঙ্গল। বাইক থামিয়ে দাঁড়াই ইহলোকের শেষ জংশনে। এখানে ইঞ্জিন বদলে ধোঁয়ার শকটে পাড়ি দেয় একটি নশ্বর দেহ অনন্তধামে! শ্মশানের বিপরীতে গাছে ঘেরা সাধু আশ্রম। বাইক চলল এগিয়ে। এই পথটি গুসকরা থেকে ভাল্কির বুক ছুঁয়ে মানকর, বুদবুদ হয়ে কসবায় গেছে। সারা দিনে দু’টি মাত্র বাস। ভাল্কির পরে শালবন টেনে দিল প্রতাপপুর পর্যন্ত। বাইক ডান দিকে এক ফরেস্ট লেনে ঢুকে পড়েছে। ভারী জঙ্গলের ঢাকনায় ছিপছিপে পথ। মাঝে মাঝেই পরিত্যক্ত পুকুর, বাঁশঝাড়। ঝোপ জঙ্গলের ছায়ায় বাউড়িপাড়া। এই মেটে পাড়াগুলি মহাফেজখানায় পড়ে থাকা ধূলিধূসর প্রাচীন দস্তাবেজের মতোই। বনমালিপুর, কুচিডাঙা, সাপমারা, কাজিপাড়া বসতিগুলি জাতপাত অনুসারি হলেও মানুষগুলি মুক্ত মনের। গ্রামের পশ্চিমে আশ্রমটিও মনের বিশ্রামের উপযুক্ত স্থান। প্রশস্ত প্রাঙ্গন জুড়ে বট, বুড়ো শিবমন্দির, কীর্তন-মঞ্চ, আর জটা বাবা। ঘুরে ফিরে প্রায় শেষ বিকেল। ঢুকে পড়েছি বাঙাল পাড়ায়। ও পার বাংলার কলোনি। আনাজ চাষই ওঁদের ভরসা। জৈব সারের কারিগর অনিল বিশ্বাস হাতে ধরিয়ে দিলেন খেত ছেঁড়া বল কপি, ফুল কপি, পুনকা শাক। তাঁর এই ফসল উড়োজাহাজে নিয়ে গেছেন আমেরিকার কনসাল জেনারেল বেথ পেনও। ম্যাডাম তাঁকে জৈব সারে লেগে থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এ চাষের খরচ পোষাবে কে? অনিল সে দিন প্রশ্নটা করে উঠতে পারেননি ম্যাডামকে।
শীতের সন্ধ্যা নামছে। শিশির পড়ছে। হিম বাড়ছে। পল্লি রমণীরা আমন্ত্রণ জানিয়েছেন পিঠে-পুলির, শিবরাত্রির মেলার, বহমান উৎসবের। আর এই সময়টায় এলে ল্যাবানের ডাক রইল দাদা— এমন আন্তরিক আহ্বান, দূষণহীন পরিবেশ, শোষণহীন পরিজন। অতীতের স্মৃতিমেদুর পল্লির প্রান্তে আশ্রমিক ছায়ায় বসে সাধু বচন, অরণ্যের পথে পথে নিঃশব্দ বিচরণ, সব মিলিয়ে শহরের কত কাছে স্বপ্ন-ভূমি ভাল্কি, শুধু অচেনায় কত দূর সে!
কী ভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে গুসকরা স্টেশনে নেমে গাড়িতে ১৯ কিমি অথবা লোকালে বর্ধমান নেমে আসানসোল প্যাসেঞ্জারে মানকর নেমে বাকি ৮ কিমি গাড়িতে। কলকাতা থেকে গাড়িতে ঘণ্টা তিনেক। থাকা— সজলধারা প্রকল্পের গেস্টহাউস। ডবল বেডের তিনটি ঘর, একটি ডর্মিটরি। জল-বিদ্যুৎ পর্যাপ্ত। রান্না ওঁদেরই ব্যবস্থাপনায়।
বুকিংয়ের জন্যে যোগাযোগের নম্বর: কৃষ্ণগোবিন্দ মিশ্র ৯৫৯৩৫৪০৫০৮ এবং কমল বন্দ্যোপাধ্যায় ৯৪৭৪৪৯১৪০২।